ইষ্টিকুটুম

অলংকরণ: তুলি

১.
না, বলতেই হবে। এভাবে কথাগুলো চেপে রেখে কোনো লাভ নেই। নয়তো একদিন পস্তাতে হবে। এমনটা সৌরভ কোনো দিন চায় না। সে বলে দেবে, তারপর? যা হওয়ার হবে। কত কিছুই তো না চাইতেই হচ্ছে। হোক না আরও একটু। ডোন্ট কেয়ার।
পড়ার টেবিলে জৈব যৌগের জটিল শব্দগুলো মেমোরাইজড না করে চিন্তা করতে থাকে, কীভাবে বলবে? সরাসরি? না, সরাসরি বলতে কোনো দিনই হয়তো পারবে না। অন্তত তাকে দিয়ে হবে না। কলেজের ল্যাবে যাওয়ার সময় যদি দেখা হয়ে যায় আর মিষ্টি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া! কেমন আছ? তখন শুধু আলহামদুলিল্লাহ, তুমি? এটুকু বলতেই বুকে বৈশাখীর কালো মেঘের বজ্রপাত ঘটে যায়। আর সেই তিনটি শব্দ কীভাবে বলবে?
বায়োলজি বইটা বন্ধ করে টেবিলে রেখে লাইট অফ করে সৌরভ। বিছানায় শুয়ে চিন্তা করছে, কীভাবে সম্ভব?
আচ্ছা, এমনটা করলে কেমন হয়? শ্রাবণী আর নাজিমউদ্দীনের প্রেমের ঘটকালি তো সে–ই করেছিল, এর সুবাদে শ্রাবণীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। আচ্ছা! শ্রাবণীর মাধ্যমে ভালো লাগার কথা জানালে কেমন হয়। দিন তিনেক চেষ্টার পর, শ্রাবণীকে একদিন তিনতলার সিঁড়িতে পাওয়া গেল। এটা মোটামুটি সুরক্ষিত জায়গা। তাকে সব বুঝিয়ে বলল সৌরভ। সে শুধু মাথা নিচু করে মুচকি হাসতে লাগল। কথা বলা শেষে শ্রাবণী বলল, আমি পারব না! সৌরভ বলল, ঠিক আছে, পিঁয়াজু আর চিপস? একগাল হেসে বলল, কোক হলে খারাপ হয় না।

২.
চারদিকে শীতের আগমনী বার্তা। শেষ রাতে লেপ বা মোটা কম্বলের দরকার হয়। এমন দিনের ভোরবেলা অদ্ভুত এক মায়ার চাদর বিছিয়ে দেয়। মনে হয়, আহা, আজ যদি বিছানা থেকে না উঠতাম। যদি ছুটির দিন হতো, কতই না ভালো হতো! তবে আজ সৌরভকে উঠতেই হবে। সকাল আটটায় কলেজে গোলাপ স্যারের ইংরেজি প্রাইভেট আছে। তার আগে মেসের খাবার তৈরি করতে হবে। দায়িত্ব আজ সৌরভের কাঁধে। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠতে হলো। ছয়জনের জন্য সাত কাপ চাল আর কয়েকটি বেগুন গ্যাসের চুলায় তুলে দিয়ে জমানো ঠান্ডা পানিতে গোসল সেরে নিল সৌরভ। ভেজে রাখা শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ, কয়েকটি রসুনকুচি, শর্ষে তেল আর পরিমাণমতো লবণ মিশিয়ে সুস্বাদু ভর্তা করে ফেলল। খাওয়া শেষে গোগ্রাসে গিলে প্রিয় পঙ্খিরাজের পিঠে চড়ে পেডেল চাপতে চাপতে রওনা হয় কলেজের দিকে।
বিশ্বরোডের দুই পাশে গড়ে ওঠা বাজারের জ্যাম পেরিয়ে কলেজ যাওয়ার রাস্তা, গ্রামীণ মেঠো পথ। আশপাশ হালকা কুয়াশায় আচ্ছন্ন। মাঝেমধ্যে দু–একজন জবুথবু কৃষক অটোভ্যানে করে শীতের সবজি নিয়ে যাচ্ছেন বাজারে। রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা। শান্ত পরিবেশ। পথের মোড় ঘুরতেই খটাশ করে শব্দ হয়ে সাইকেলের চেইন পড়ে গেল। ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি। সৌরভের চোখেমুখে বিরক্তি ভাব। আজই কেন এমনটা হতে হবে! সাইকেল থেকে নেমে চেইন ঠিক করতে যাবে, ঠিক এমন সময় খানিক দূরে কুয়াশার ঝাপসায় একটি নারী মূর্তি চোখে পড়ল। কে ওটা? ফারজানা? ড্রেসআপ তো ওর মতোই? তাহলে? কিন্তু এত সকালে কেন? ও তো ১০টায় কলেজে আসে। অনেক কষ্টে সাইকেলের চেইন ঠিক করে আবার পেডেলে পা চালাল সৌরভ। একটু কাছে যেতেই অনুমান সত্যি হলো, মেয়েটি ফারজানা। যাকে ভালো লাগার কথা বলার জন্য কত চেষ্টাই না করে যাচ্ছে সে। আজ এভাবে সামনে পেয়ে যাবে, কল্পনাও করেনি সৌরভ। সাইকেল থেকে নেমে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ নীরবতা, কেউ কিছু বলছে না। সৌরভ মনে মনে ভাবছে, এটাই কি মনের কথা বলার জন্য সেরা সময়? জমিয়ে রাখা সব কথা বলে দেবে? বুকে সাহস সঞ্চয় করে নিল সে। কীভাবে শুরু করবে, তা কল্পনায় বলতে বলতে মুখস্থ হয়ে গেছে। এখন শুধু আওড়ানো বাকি।

সামনেই করতোয়া নদীর ব্রিজ। সৌরভ সাহস করে সালাম দিল। ফারজানা তার মায়াবী কণ্ঠে জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?
ভালো। তুমি?
আমিও ভালো।
এরপর আবার কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। যেন দুজনই কথা হারিয়ে ফেলেছে। অবশেষে নীরবতা ভাঙল সৌরভ। জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলল, শ্রাবণী তোমাকে কিছু বলছে?
শ্রাবণী? কই না তো?
ও কিছুই বলেনি?
কী বলবে?
সৌরভ এখন আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না, নার্ভাস লাগছে। শীতল বাতাস গায়ে মাখানো আবহাওয়ার মধ্যেও কপালে ঘামের বিন্দু জমেছে। গলা যেন শুকিয়ে গেছে। দিনের পর দিন গুছিয়ে রাখা কথাগুলো হঠাৎ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন গায়েব করে নিয়েছে।

৩.
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বয়ে গেল দুজনের মধ্যে, কেউ কোনো কথা বলছে না। ফুলকপিবোঝাই একটি অটোভ্যান চলে গেল পাশ দিয়ে। সকালের অভুক্ত কয়েকটি কুকুর আনাগোনা করছে। সৌরভ কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় ফারজানা বলে উঠল, তুমি কী বলবে, আমি বুঝতে পারছি। তোমাকে আমি আমার নিজের ভাইয়ের মতো দেখি। কোনো দিন ওইভাবে কিছু ভাবিনি। কলেজে আমার থেকে আরও কত সুন্দর মেয়ে আছে। সবাই কেন শুধু আমার পেছনে পড়ে থাকে, বুঝতে পারি না।
তোমার চোখ অনেক সুন্দর! এ কথা বলতে বলতে কয়েকবার ঝাঁকুনি খায় সৌরভ। এরপর আবার কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।
তোমার কাছে পানি আছে?
হ্যাঁ, দাঁড়াও।

পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিল ফারজানা। কয়েক ঢোক পানি পান করল সৌরভ। বোতলটি এগিয়ে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু। হঠাৎ মনে হলো, ওদের পরিচিত কোনো বন্ধু যদি দুজনকে একসঙ্গে আসতে দেখে, তাহলে সন্দেহ করে কি–না–কি ভেবে বসে! তাই সৌরভ নিজ থেকেই সাইকেলে টান দিয়ে আগে চলে গেল।

আজ আর প্রাইভেট পড়তে যায়নি সে। মাথায় বিভিন্ন চিন্তা এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওয়াশরুমে গিয়ে পানিতে মাথা ভিজিয়ে মুখে বার কয়েক পানির ঝাপটা দিল। ক্লাসরুমে এখনো কেউ আসেনি। কিছুক্ষণ একা বসে থাকলে নার্ভাস ভাবটা কেটে যাবে। সিলিংফ্যানের সুইচ অন করে ক্লাসরুমে বসল সৌরভ। ভাবছে, ফারজানার সামনাসামনি আর কখনো হতে পারবে! সে যে তাকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করে। এরপর কি আর সামনে এগোনো যায়!