বিজয়ের পতাকা

আনোয়ার হোসেনের তোলা এই ছবিটি হয়ে উঠেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতীক। ১৯৭১–এ এটি তোলা হয়েছিল ঢাকার দোহারের একটি গ্রাম থেকে
রাতুল জানত তাদের জীবন অনিশ্চিত। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে। তাই এ কথা শোনার পর কষ্ট লাগলেও ভেঙে পড়েনি।

অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে রাতুল। বয়স ২০ থেকে ২১। তরুণ এবং কর্মঠ। যথেষ্ট শক্তি ও সৎসাহস তার আছে। বিশেষ করে এই সময়ে। চারদিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে। গ্রামগঞ্জে কিছুটা কম হলেও মাঝেমধ্যে ঝড়ের গতিতে দল বেঁধে পাকিস্তানি সেনারা শক্তিশালী অস্ত্র ও কামান নিয়ে ধেয়ে আসে। হাতের কাছে যাকে পায়, নির্দ্বিধায় গুলি করতে পিছপা হয় না। শিশু, বয়স্ক, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারীরা পর্যন্ত রেহাই পান না। বিবেকের লেশমাত্র নেই কারও মধ্যে। ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে পুরো দেশবাসী। যে যা পারে, তা নিয়েই ঘাতক পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করছে।

সেদিন ছিল শুক্রবার। সকাল থেকে অনেক বৃষ্টি। থামার লেশমাত্র নেই। রাতুলের হঠাৎ পিঠা খেতে ইচ্ছা করছে খুব। গরম-গরম তেলের পিঠা খাবে। এদিকে গরুর খড় না থাকায় বাবা গেল খড় আনতে। বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে। এই ফাঁকে মাকে বলে রাতুল বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গেল। ফেরার পথে বন্ধুদের পিঠা খাওয়াতে নিয়ে আসবে।

বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। অনেক সরু। সময়টা অক্টোবরের মাঝামাঝি। নদীতে তখনো বেশ পানি। প্রায়ই নদী দিয়ে অজ্ঞাত মানুষের লাশ ভেসে আসে। গ্রামের জহুরুল কাকা। তিনি সে সময়েও নিয়ম করে নৌকায় লোক পারাপার করেন। রাতুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে জহুরুল কাকার নৌকায় নদী পার হয়ে মণ্ডলপাড়ায় গেল। ওপাড়ায় কলেজবন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে। বসুদেব, দীপু, হৃদয়দের সঙ্গে রাতুলের বেশ মিল। ঘণ্টাখানেক ফুটবল খেলা শেষে গোসল সেরে তারা পিঠা খেতে রাতুলদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। নদীর কাছে আসতেই জহুরুল কাকা উচ্চ স্বরে রাতুল, রাতুল বলে ডাক দিল। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘মিলিটারি, মিলিটারি। তোদের বাড়িতে মিলিটারি গিয়েছিল। তোর বাবার খোঁজে। বাবাকে খুঁজে না পেয়ে তোর মাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে এবং বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।’

রাতুল বাড়িতে গিয়ে দেখল তার মায়ের নিথর দেহ রান্নাঘরে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে। সদ্য বানানো পিঠাগুলোও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। চিৎকার দিয়ে মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে গেল সে। এরই মধ্যে তার বাবা এসে হাজির। সব দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি।

রাতুলের বাবা শ্যামল মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সদস্য। যুদ্ধের প্রথম থেকেই বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নতুন মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়। সপ্তাহের ছুটির দিনে, অর্থাৎ শুক্রবার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসে প্রায়ই। মিলিটারিরা এই খবর গোপন সূত্রে জানতে পেরে আজ আচমকাই হামলা করেছে। তবে দমে যাওয়ার পাত্র নন তিনি। চোখমুখে পানি দিয়ে সন্তানের জ্ঞান ফেরালেন। তারপর সান্ত্বনা দিয়ে পরদিন আবারও যুদ্ধে চলে গেলেন। রাতুল যুদ্ধে যেতে চাইলেও তার বাবা রাজি হননি। বলেন, ‘তুমি এসব পারবে না। সবে কলেজ পড়ো। এখনো অনেক কিছুই বোঝার বাকি।’

নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় আবারও ছেলেকে দেখতে আসে শ্যামল। এবার রাতুলকে নিয়ে যাবে। বহরমপুর মুক্তিবাহিনীর মূল ক্যাম্পের অস্ত্র পাহারাদার মিলিটারির গুলিতে আহত হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায়। শ্যামলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সে। এখন একজন অস্ত্র পাহারাদার লাগবে। সে জন্যই রাতুলকে নিতে আসা। রাতুলের সঙ্গে তার তিন বন্ধুও যেতে রাজি হয়ে গেল। বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো তাদের। বহরমপুর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাহারা দেওয়া এবং তালিকা অনুযায়ী নবীন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়াই তাদের কাজ।

নভেম্বর মাস প্রায় শেষ। একদিন রাতে রাতুলরা মিলে পরিকল্পনা করছিল। হঠাৎ কবীর মামা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসে জানাল, রাতুলের বাবা শাহাদাতবরণ করেছে। ঢাকায় ৫০০ মিলিটারি, অফিসার ও মিলিটারিদের অস্ত্র কারখানায় গোপনে ঢুকে আত্মঘাতী হামলায় মৃত্যুবরণ করে।

রাতুল জানত তাদের জীবন অনিশ্চিত। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে। তাই এ কথা শোনার পর কষ্ট লাগলেও ভেঙে পড়েনি। ৫০০ জানোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে তার নির্ভীক বাবা। এ তো বীরত্বের মৃত্যু, গর্বের মৃত্যু। তাদের মনের জোর আরও বেড়ে গেল।

রাতুল ও তার বন্ধুরা এবার সিদ্ধান্ত নিল, তারাও মাঠে যুদ্ধ করবে। দেশব্যাপী শুরু হয়ে গেল চূড়ান্ত লড়াই। পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে কখনো রাস্তায়, কখনো গোপন আস্তানায়, কখনোবা সম্মুখযুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয় তারা। চারদিক থেকে খবর আসতে থাকে, পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও আত্মসমর্পণ করেছে। একে একে সারা দেশে বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। একদিন বহরমপুরেও লাল-সবুজের পতাকা উড়ল। চারদিকে বিজয়মিছিল। কিন্তু সেই মিছিলে নেই রাতুল ও তার বন্ধুরা। সবাই তাদের খুঁজছে।

এদিকে, পোড়া বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড়ের খানিকটা জায়গাজুড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত রাতুলের মা। বন্ধুরা মিলে সেই কবরের পাশে বিজয়ের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতুল বলছে, ‘মা, আজ থেকে আমরা স্বাধীন। বিজয় শেষে অনেকেই তাদের মায়ের কোলে ফিরেছে। কিন্তু আমার সৌভাগ্য হয়নি তোমার কোলে ফেরার। তাই তো এসেছি এখানে। নিয়ে এসেছি বিজয়ের পতাকা।’ কথাটি বলার পর রাতুল অঝোরে কাঁদতে থাকে।

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়