একটা সময় মানুষের পদচারণ ছিল, এখন প্রকৃতির দখলে

করোনার সময় কক্সবাজারের সৈকত সাগরলতায় ভরে যায়
ছবি: আব্দুল কুদ্দুস

করোনার সময়ের কথা মনে আছে? সব সময় মানুষের পদচারণে মুখর থাকা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। এ সুযোগে প্রকৃতি ফিরে পায় তার নিজস্বতা। লোকালয়ের একদম কাছে এসে ডিগবাজিতে মাতে ডলফিনের দল, সাগরপাড়ে কচ্ছপের অবাধ বিচরণ ও ডিম পাড়া নিয়েও অনেক নিউজ হয়েছে। এ ছাড়া দেখা মেলে সাগরলতা উদ্ভিদেরও। এই উদ্ভিদ সৈকতের অন্য প্রাণী যেমন কাঁকড়া ও পাখির টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এখন আবারও পুরোনো রূপে ফিরে গেছে কক্সবাজার। লোকালয়ের কাছে ডলফিনের ডিগবাজিও আর দেখা যায় না।

মানুষ যখন কোনো একটি স্থানে তাঁদের পদচারণ কমিয়ে দেয়, ধীরে ধীরে সেই স্থানটি প্রকৃতি তার দখলে নিয়ে নেয়। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য স্থান রয়েছে, যেখানটায় একটা সময় অসংখ্য মানুষের পদচারণে মুখর ছিল। সময়ের পালাবদলে সেই স্থানগুলো থেকে মানুষ অন্যত্র পাড়ি জমায়। এই সুযোগে জায়গাগুলো ধীরে ধীরে প্রকৃতি দখল করে নিয়েছে। আজ বিশ্বের এমন পাঁচটি স্থানের গল্প বলব।

তা প্রহম
ছবি: এএফপি

তা প্রহম, কম্বোডিয়া
এটি একটি বৌদ্ধমন্দির। এর অবস্থান কম্বোডিয়ার প্রাচীন খেমার সাম্রাজ্যের রাজধানী আঙ্কোর থমের পূর্ব দিকে। ১২০০ শতাব্দীর পরে বৌদ্ধবিহার ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটির নির্মাণ করা হয়। প্রায় ১৩ হাজার মানুষ এই বৌদ্ধবিহারে থাকত এবং সেবা করত। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বসবাস করত আরও ৮০ হাজারের বেশি মানুষ।

তিন শতাব্দী পরে রাজা আঙ্কোর থেকে সাম্রাজ্যের রাজধানী সরিয়ে নিলে মন্দির এবং আশপাশের বনাঞ্চল পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এর পর থেকে মন্দিরটিতে মানুষের পদচারণ তেমন পড়েনি। ধীরে ধীরে সেখানে বৃক্ষ জন্ম নেয়, বনাঞ্চল গড়ে ওঠে। পশুপাখিরও বসবাস শুরু হয়।

বৈশ্বিক পরিবেশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ডলাইফ অ্যালায়েন্সের তথ্যমতে, গত শতাব্দীতে অত্যাধিক শিকার এবং অবৈধ ব্যবসার আগে আঙ্কোরের আশপাশের বনে প্রাণীদের ব্যাপক বসবাস ছিল। এ কারণে জনসংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। অবৈধভাবে প্রাণী শিকারের পর এখনো হরিণ, বুনো শুয়োর, চিতাবাঘ, বিড়ালসহ সাধারণ প্রজাতির অল্প কিছুসংখ্যক প্রাণী এখনো রয়ে গেছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে কম্বোডিয়া সরকারের সঙ্গে মিলে ওয়াইল্ডলাইফ অ্যালায়েন্স, ২০১৩ সাল থেকে আঙ্কোরের বনাঞ্চলে গিবন, রূপালী ল্যাঙ্গুর, মসৃণ প্রলিপ্ত ওটার, হর্নবিল এবং বিপন্ন সবুজ ময়ূরসহ আরও প্রাণী ছেড়েছে।

হাওতোয়ান গ্রাম
ছবি: জোহানেস আইজেল/ এএফপি

হাওতোয়ান, সেংশান দ্বীপ, চীন
একটা সময় হাওতোয়ান গ্রামে তিন হাজারের বেশি মানুষের বসবাস ছিল। কিন্তু এটি অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল। মূল ভূমি থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি দূরত্ব। শিক্ষা, চাকরি, খাদ্যসহ সবকিছুরই অভাব ছিল সেখানে। এ কারণে ১৯৯০-এর দশকে সেখান থেকে মানুষ শহরমুখী হতে শুরু করে। ২০০২ সাল নাগাদ পুরো জনশূন্য হয়ে পড়ে গ্রামটি।

বর্তমানে গ্রামটিকে প্রকৃতি পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। দেখলে মনে হবে কোনো ভুতুড়ে নগরী। এ কারণে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এটি। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্যমতে, কেবল ২০২১ সালেই ৯০ হাজারের বেশি দর্শনার্থী গ্রামটিতে ঘুরে গেছেন।

মাঙ্গাপুরুয়া ভ্যালি
ছবি: পিটার লরেনসন

মাঙ্গাপুরুয়া ভ্যালি, নিউজিল্যান্ড
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নিউজিল্যান্ডের উত্তর দ্বীপের মাঙ্গাপুরুয়া ভ্যালিতে সৈন্যদের তাঁদের পরিবারসহ বসবাস করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশেষ করে যেসব সৈন্য, সৈনিক জীবন শেষ করেছেন, তাঁদেরকে। ১৯১৯ সালে মাঙ্গাপুরুয়া ভ্যালি খুলে দেওয়া হয়। এর পর থেকে অন্তত ৪০ জন সৈন্য ও তাঁদের পরিবার সেখানে বসবাস করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং কৃষিকাজ করার জন্য উর্বর ভূমি না থাকায় ১৯৪০-এর দশকের মধ্যে সবাই এখান থেকে চলে যান। এর পর থেকেই জায়গাটি পরিত্যক্ত এবং প্রকৃতি পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে।

সৈন্যরা সেখানে বাড়ি, কৃষি খামার, কালভার্ট, রাস্তাসহ আরও অনেক কিছুই নির্মাণ করেছিল। সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ আজও রয়ে গেছে। এখন ভূমিটি ওয়াংগানুই ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্ভুক্ত।

১৯১১ সালে জাহাজটি ডুবে যায়
ছবি: শাটারস্টক

স্টিম শিপ ইয়ংলা, অস্ট্রেলিয়া
১৯১১ সালে সাইক্লোনের কবলে পড়ে সমুদ্রে ডুবে যায় অস্ট্রেলিয়ান জাহাজ স্টিম শিপ ইয়ংলা। জাহাজটিতে যাত্রী, ক্রুসহ ১২২ জন ছিল। সমুদ্রের তলদেশে সবার সলিলসমাধি ঘটে। টানা সাত দিন খোঁজাখুঁজির পরও কোনো ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি। ১৯৫৮ সালে জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। এটিকে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম বড় ট্র্যাজেডি বলা হয়।

বর্তমানে সমুদ্রের তলদেশে থাকা জাহাজটি সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের সঙ্গে মিশে গেছে। এটিতে অসংখ্য মাছ ও কোরালের বসবাস।

আল মাদাম গ্রাম
ছবি: জিউসেপ ক্যাকাস/ এএফপি

আল মাদাম গ্রাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত

দুবাই শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটি ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, আদিবাসী আরব বেদুইনদের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বেদুইনরা সাধারণত মরুভূতিতে বসবাস করে থাকে। তাদের স্যাটেলমেন্ট করাই তৎকালীন প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল। ওই গ্রামে তখন প্রায় ১০০ জন মানুষ বসবাস করত। কিন্তু দুই দশক পরেই গ্রামটি খালি হয়ে যায়।

বর্তমানে পুরো গ্রামটি মরুভূমির সঙ্গে মিশে গেছে। তবে কেন এমন হলো, এ ব্যাপারে সঠিক কারণ জানা না গেলেও গবেষকেরা জানান, দুবাই এবং শারজার মতো শহরের উত্থানের ফলে মানুষ উন্নত জীবনের আশায় শহরমুখী হচ্ছে। গ্রামটির মানুষও ধীরে ধীরে সেদিকেই পা বাড়িয়েছে।

তথ্যসূত্র: সিএনএন ট্রাভেল