স্মৃতির ঝাঁপি থেকে ৭১-এর শহীদজায়া মুশতারী শফি

শহীদজায়া মুশতারী শফির সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলায় বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন উম্মে কুলসুম মুশতারী বেগম ওরফে ডলি। জন্ম ১৯৩৮ সালে ১৫ জানুয়ারি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মালদহ জেলার কালিয়াচক থানায়। পিতা খন্দকার নজমুল হক আনসারীর আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলায়। মাতা আরেফা খাতুন। বাবা ছিলেন ডেপুটি পুলিশ সুপার। বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতায় বসবাস করতেন। মাত্র তিন মাস বয়সে ছোট্ট ডলি মাকে হারান। বাবাও ১২ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। শিশুকাল থেকে শুরু হয় মুশতারীর জীবনসংগ্রাম। কত চড়াই-উতরাই পারি দিতে হয়েছে। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে ছিল বিষাদ আর সংগ্রাম।

১৯৫৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে দন্তবিশেষজ্ঞ শফির সঙ্গে মুশতারী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর থেকে পরিচিত হন মুশতারী শফি নামে। কিশোরী বয়সে বিয়ে করলেও পড়ালেখার ইতি টানেননি। ডাক্তার শফি গৃহশিক্ষক রেখে পড়ালেখা শিখিয়েছেন জীবনসঙ্গিনীকে। ছোটবেলা থেকে ছিলেন সংস্কৃতিমনা, উচ্চাঙ্গ সংগীত করতেন, গিটার বাজাতে পারতেন বেশ ভালো। মুশতারী শফির সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকার কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল। বাস্তব জীবনের জাঁতাকলে পড়ে লেখাপড়া একটা সময় বন্ধ হয়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকলেও প্রকৃতিগতভাবে মুশতারী শফি ছিলেন তুখোড় মেধাবী। প্রচুর বই পড়তেন, মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করেন। দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ছোটদের আসর ‘মুকুলের মাহফিল’ এ ছোটগল্প লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখি ও সাহিত্যজগতে বিচরণ। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে তাঁর উদ্যোগে বান্ধবী সংঘ গঠন করা হয়। এটি ছিল চট্টগ্রামে নারীদের প্রথম সংগঠন। বলা যায় তিনি ছিলেন সে সময়ে নারীদের অগ্রপ্রতিক এক জিয়নকাঠি। চট্টগ্রাম থেকে ‘বান্ধবী’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৯ সালে ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানাও চালু করেছিলেন।

১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন বান্ধবী পত্রিকায় প্রচ্ছদ ছাপা হয় দেশের মানচিত্র, তার ওপর বেয়নেটের আঘাতের ছবি। এই ছবি দিয়ে তিনি প্রতিবাদ করে বুঝিয়েছিলেন যে এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। দেশ রক্ষায় সবাইকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। সে সময় পাকবাহিনী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় ‘মেয়েদের প্রেস’।

চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে ‘মুশতারী লজ’ ছিল মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ স্থল। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ মুশতারী লজে লুকিয়ে রাখা হতো। এটাই মুশতারী শফির পরিবারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল মুশতারী পরিবারের জন্য ছিল ভয়াবহ দিন। সেদিন রাতে পাকিস্তানিরা ডাক্তার শফি ও মুশতারীর ছোট ভাই এহসানুল হক আনসারীকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মুশতারী শফি। তাঁদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বামী ও ভাইহারা জায়া মুশতারী শফি তাঁর ফুলের মতো ছোট ছোট সাত সন্তানকে নিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি পিছপা হননি; মা, মাটি ও মাতৃভূমির টানে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেন। ছোটবেলা থেকে পিতামাতাহারা এতিম এবং একাত্তরের স্বামী ও ভাইহারা জননী ধৈর্যের সঙ্গে তিলে তিলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ান।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। সন্তানদের কখনো পিতার অভাব বোধ করতে দেননি। শহীদজায়া মুশতারী শফি  সন্তানদের কাছে ছিলেন বটবৃক্ষ।

মুশতারী শফি শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমামের সহযোদ্ধা ছিলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মারা যাওয়ার পর শহীদজায়া মুশতারী শফিকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। তিনি উদীচীর চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ছিলেন। চট্টগ্রামে একজন আদর্শ নারী নেত্রীর মডেল হিসেবেও কাজ করেছেন। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তিনি কখনো ছিলেন শহীদজায়া, কখনো সাহিত্যিক, কখনো শব্দশৈলী হিসেবে। আমার কাছে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ মা, একাত্তরের এক জীবন্ত দলিল; যিনি মা, মাটি ও মাতৃভূমিকে নিজ সন্তানের মতো হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসে গেছেন। বুকে আগলে রেখেছেন একাত্তরের স্মৃতিকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন, ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও একুশের গল্প’, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’ ইত্যাদি গ্রন্থ। তাঁর প্রতিটি বই একাত্তরের এক একটা প্রামাণ্য দলিল।

২০১৬ সালে শহীদজায়া মুশতারী শফিকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেলোশিপ দেওয়া হয়। ২০২০ সালে তাঁকে রোকেয়া পদক দেওয়া হয়। এ ছাড়াও তিনি অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন। ২০০৩ সালের দিকে চট্টগ্রাম বন্ধুসভায় কাজ করার সময় থেকে শহীদজায়া মুশতারী শফিকে চিনতাম।

একদিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মুশতারী লজে গিয়ে হাজির। আমার লেখা ‘একাত্তরের শহীদ ছবুর’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে মুশতারী আন্টি মুগ্ধ হলেন। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে পরম যত্ন করে একাত্তরের শহীদ ছবুর বইয়ের ভূমিকা লিখলেন। দোয়া করে দিলেন আমাকে। ২০১৬ সালে বইটি বলাকা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হলে ‘মুশতারী লজে’ গিয়ে বইটি ওনার হাতে তুলে দিই। তিনি অনেক খুশি হয়ে বললেন, ‘রশীদ এনাম বাবা, দেখো! শহীদ ছবুরের মতো অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জীবন ধামাচাপা পড়ে আছে। তোমার মতো যদি অন্যরা এভাবে লিখত, আগামীর প্রজন্মরা শহীদ ও একাত্তরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারত। মাঝেমধ্যে ফোনে খোঁজখবর নিতাম। ২০১৮ সালে ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার নিয়ে মুশতারী লজে গিয়েছিলাম। আন্টি অনেক খুশি হলেন। বসে অনেক গল্প করলাম, চা খেলাম। এটাই ছিল ওনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।

একাত্তরের শহীদ ছবুর বইয়ে ভূমিকা লিখেছিলেন মুশতারী শফি। তাঁর লেখার কিছু অংশ তুলে ধরলাম:
‘হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পরিচয়, আমরা বাঙালি। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এই বাংলাদেশটি আমরা নিজস্ব করে পেয়েছি। অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত, অনেক তিতিক্ষা এবং পরিশেষে তিরিশ লক্ষাধিক বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির এমন একটি জায়গা ছিল না, যেখানে শহীদের রক্ত ঝরেনি এবং তাঁদের অনেকের দেহাবশেষের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত নেই। কেউ ভেসে গেছে পদ্মা, মেঘনা, কর্ণফুলি নদীর বুকে, কেউ ভেসে গেছে অথৈ সমুদ্রের মাঝে, কেউ কেউ পাহাড়ে জঙ্গলে শেয়াল শকুনের আহার্য হয়েছে, আর কিছু সংখ্যক মানুষকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। তখন যেখানে সুযোগ হয়েছে সেখানে। পাশাপাশি অজস্র গণকবর আর বধ্যভূমিতে ভরেছিল এই দেশটি। এ রকম পরিস্থিতিতে গাজী আবদুস ছবুরও শাহাদতবরণ করেছেন।

দেশবাসী জানতে পারছে শহীদ ছবুরের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া থানার শেয়ানপাড়া গ্রামের নাম। সেই সঙ্গে আজ জানছে শেয়ানপাড়া গাজী বাড়িসংলগ্ন শহীদ আবদুস ছবুর পাঠাগারটির কথা, যেটি পরবর্তীতে বন্ধ করে দিয়েছিল তাঁরই গ্রামের লোকজন। কিন্তু সত্য থাকে চিরদিন অমলিন। আজ একাত্তরের প্রজন্ম লেখক রশীদ এনাম তুলে এনেছেন শহীদ আবদুস ছবুরকে। উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুস ছবুর স্মৃতি পাঠাগার ও শহীদ আবদুস ছবুর স্মৃতি ট্রাস্টের কথা। এই শেয়ানপাড়া গ্রামেই শহীদ ছবুরের নামে একটি স্কুল বা কলেজ ও স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এভাবেই তাঁর স্মৃতি ও কর্মকাণ্ড প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকবে। তবে তাঁর কবর যেখানে আছে তা আরও সুন্দর সুসংহত করে যাতায়াতের সুব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই।’

বেগম মুশতারী শফি
২৫/১২/২০১৫
‘মুশতারী লজ

মুশতারী শফি হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় লিখে গেছেন, ‘এখন প্রতিবাদ চাই। প্রতিরোধ চাই। চাই রাজনৈতিক আদর্শিক সংগ্রাম। যারা ১৯৭১-এ নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে এবং নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সেই খুনিদের সঙ্গে কোনো আপস হতে পারে না। এবার বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক। অতীতের সব ত্রুটিবিচ্যুতি ঝেড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক।’

লেখাটি ছিল একাত্তরের চেতনা এবং প্রতিবাদ। ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর শহীদজায়া মুশতারী শফি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা