দেড় শ বছর আগের কলকাতা। মেয়েদের বাড়ির বাইরে পা রাখতে হলে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হতো; মুখ ঢাকতে হতো অবগুণ্ঠনে। তথাকথিত ভদ্র বাড়ির মেয়েরা থিয়েটারের দলে নাম লেখানোর কথা ভাবতেই পারতেন না! সেই সময়ে বাংলা থিয়েটারজগতে আবির্ভাব ঘটে নটী বিনোদিনীর। সোনাগাছির এক অন্ধকার গলিতে জীবন শুরু করলেও তাঁর জ্যোতিতে এক দশক আলোকিত হয়েছিল বাংলার মঞ্চ।
যৌনকর্মীর সন্তান হওয়ায় বিনোদিনীকে সারা জীবন সহ্য করতে হয়েছে অনেক অপমান, যন্ত্রণা। মাত্র ১২ বছর বয়সে থিয়েটারজগতে পদার্পণ। প্রমীলা, দ্রৌপদী, পদ্মিনী, লেডি ম্যাকবেথ, দময়ন্তী, শ্রীচৈতন্যসহ নানা বলিষ্ঠ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর রূপ ও অভিনয়ক্ষমতার টানে ছুটে এসেছেন একাধিক পুরুষ। জমিদার বংশের কুমার বাহাদুর, ঠাকুরবাড়ির সন্তান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও অনেকে। কিন্তু তাঁর জীবনের কোনো প্রেমই সেভাবে পূর্ণতা পায়নি। নিষিদ্ধপল্লি থেকে উঠে আসা একটা মেয়েকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে যে অধিকাংশ পুরুষেরই পা কাঁপে!
বিনোদিনী, গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল এবং দলের অন্য সদস্যরা চেয়েছিলেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক প্রতাপচন্দ্র জহুরীর প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজেদের থিয়েটার দল তৈরি করার। তাঁদের অর্থনৈতিকভাবে সব রকম সাহায্য করতে রাজি ছিলেন গুরুমুখ রায় মুৎসুদ্দি। শুধু শর্ত একটাই—বিনোদিনীকে তাঁর রক্ষিতা হয়ে থাকতে হবে। দলের বাকিদের প্ররোচনায় বিনোদিনী নিজেকে বিক্রি করতেও রাজি হয়েছিলেন, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য, বাংলা থিয়েটারের সামগ্রিক উন্নতির কথা ভেবে।
বিনোদিনী স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর নামে একটি থিয়েটার হল তৈরি হবে। নাম হবে বিনোদিনী থিয়েটার। কিন্তু দলের বাকি সদস্যদের চক্রান্তে তা বাস্তবায়িত হয়নি। স্বপ্ন স্বপ্ন হয়েই থেকে গেছে।
১৮৮৩ সালে গুরুমুখের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হলো স্টার থিয়েটার। ধীরে ধীরে অভিমানে, দলীয় রাজনীতিতে ক্লান্ত হয়ে থিয়েটারজগৎ থেকে দূরে সরে গেলেন বিনোদিনী। ঘর বাঁধলেন, এক মেয়ে হলো তাঁর—শকুন্তলা। ব্যক্তিগত জীবনেও সুখ পাননি তিনি। আত্মজার মৃত্যুযন্ত্রণাও সহ্য করতে হয়েছে।
থিয়েটারের সম্রাজ্ঞী হলেও ব্যক্তিগত জীবনে বিনোদিনী দেবী ছিলেন খুব একা। বড়ই অভিমানী তিনি। এক সমুদ্র যন্ত্রণা বুকে নিয়ে মঞ্চের আলোর রোশনাই ছেড়ে মেঘের আড়ালে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলা থিয়েটারজগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। একাকিত্ব ছিল তাঁর আমরণ সঙ্গী। নিজের আত্মজীবনী ‘আমার কথা’য় তিনি লিখেছেন—
‘পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, শুধুই অনন্ত নিরাশা, শুধুই দুঃখময় প্রাণের কাতরতা! কিন্তু তাহা শুনিবারও লোক নাই! মনের ব্যথা জানাইবার লোক জগতে নাই...কেননা, আমি জগৎ মাঝে কলঙ্কিনী, পতিতা। আমার আত্মীয় নাই, সমাজ নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই, এই পৃথিবীতে আমার বলিতে এমন কেহই নাই!’
বোয়ালখালী, কধুরখীল, চট্টগ্রাম