‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশিরবিন্দু।’
শহুরে কাকডাকা ভোর ফুটতে শুরু করেছে, আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা কয়েকজন। নতুন কোনো অভিজ্ঞতার খোঁজে। উদ্দেশ্য, প্রকৃতির গহিনে হারিয়ে গিয়ে জীবনের দর্শন উপলব্ধি করা। এবারের গন্তব্য বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে। যেখানে প্রকৃতি হয়ে ওঠে শিক্ষক, আর উঁচু উঁচু টিলার ওপর ঢেউ খেলানো সবুজ চাদরের ওপর লুটোপুটি খেলছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সৌন্দর্য। এই দৃশ্য সামনে থেকে অবগাহন করার জন্যই আমাদের ভ্রমণ।
যাত্রা
ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় ঢাকার সায়দাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে হানিফ পরিবহনে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে রওনা দিলাম। বাস নারায়ণগঞ্জ হয়ে যখন যাচ্ছিল, রাস্তার ধারে চোখে পড়ল রংবেরঙের সুতা শুকানোর দৃশ্য। মনে পড়ল, এখানেই তৈরি হয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মসলিন ও জামদানি; যা পৃথিবীজুড়ে খ্যাত।
রাস্তার ধারে গ্রামবাংলার চিরচেনা গ্রামীণ জীবন, দিগন্তজুড়ে থাকা সবুজ ফসলের মাঠ, খাল-বিল, নদীর চরাচর দেখতে দেখতে যাত্রাপথের সময়টুকু অনায়াসে কেটে যায়।
রাস্তার অদূরে ক্ষণে ক্ষণে চা–বাগান দেখে আমরা বুঝতে পারি, চলে এসেছি সবুজের শহরে। বেলা ১১টা নাগাদ শ্রীমঙ্গলে পৌঁছে যাই। আমাদের অভিনন্দন জানাতেই যেন শহরের প্রবেশপথে ‘চা–কন্যা’ ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে কুঁড়ি তুলে নিচ্ছে দুই আঙুলের ডগায়। সত্যি বলতে, ভাস্কর্যটি শ্রীমঙ্গলের সৌন্দর্যকে যেন আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সবুজ স্বর্গে
শ্রীমঙ্গল ছোট্ট শহর। শহর থেকে অটোরিকশা নিয়ে আমরা রিসোর্টের উদ্দেশে রওনা হলাম। মাত্র ৪-৫ মিনিটের মধ্যে চা–বাগানের ভেতর দিয়ে রাস্তায় উঠে পড়ল গাড়ি। চোখেমুখে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে বাগানের স্নিগ্ধ, ঠান্ডা বাতাস। নিমেষেই আমাদের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে রিসোর্টের কাছাকাছি চলে আসে অটোরিকশা। ভাড়া নিয়েছে ১০০ টাকা।
কিছুক্ষণ হেঁটে রিসোর্টের গেট দিয়ে ঢোকার সময় বুঝতে পারি, প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপ যেন এখানে ঢেলে দিয়েছে।
সামনে ছোট একটি পুকুর, বেশ কিছু শাপলা ফুল ফুটে আছে। হরেক রঙের ফুলে ভরা সবুজ বাগানের মধ্যে ছোট ছোট কটেজ; বাঁশ, কাঠ দিয়ে তৈরি। রিসোর্টের এক পাশে টিলার ওপর চা–বাগান, অন্য পাশে পাহাড়ি একটি ছোট খাল বয়ে যাচ্ছে। সেখানে আবার অনবরত ঝিরিঝিরি পানি বয়ে চলার শব্দ, চারপাশে নাম না জানা বিভিন্ন পাখির গুঞ্জন, বিচিত্র সব ফুলের সুবাস আর প্রাকৃতিক নীরবতার মধ্যে এক অন্য রকম শান্তি অনুভব হচ্ছিল।
এখানকার পরিবেশ এতটাই শান্তিপূর্ণ যে একেক মুহূর্ত কাটালে মনে হচ্ছে, সবকিছু যেন থেমে গেছে। আমি এবং আমরা এখানে নীরবতার মধ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেললাম।
প্রকৃতির মুগ্ধতায় ডুবে যেতে যেতে আমরা নির্ধারিত রুমে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ওয়েলকাম ড্রিংকস হিসেবে পাহাড়ি লেবুর শরবত পাঠানো হলো, যা শরীরের ক্লান্তি ঝেড়ে মুছে ফেলতে সহায়তা করে।
এর মধ্যে আমাদের দুপুরের খাবারও চলে আসে। সবাই অনেক ক্ষুধার্ত। এতটা ক্ষুধার্ত শেষ কবে অনুভব করেছি, মনে নেই। তড়িঘড়ি খেতে বসে পড়লাম। মাটির চুলায় রান্না করা ঝোল মাখা মুরগির মাংস, ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত, শর্ষের তেলে মাখা আলুভর্তা আর ডাল—যেন স্বর্গীয় খাবার। গ্রামীণ রান্নার এমন স্বাদ শহরে পাওয়া যায় না। খাবার শেষ করে রুমে আসতে না আসতেই অঝোরে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। যেন আমাদের ভ্রমণকে ষোলোকলা পূর্ণ করে দিতেই বৃষ্টির আগমন। পাহাড় ও ঘন বনাঞ্চল থাকার কারণে শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ও ঠান্ডা এলাকার তালিকাভুক্ত। আমাদেরকেও যেন শ্রীমঙ্গল তার বৃষ্টির রূপের সাক্ষী করে নিল।
এখানকার খাবার একদম টাটকা। বাজার করে নিয়ে এসে রান্না করার পর পর্যটকদের পরিবেশন করা হয়। টাটকা খাবার খাওয়ানোর জন্যই রিসোর্টের মালিকের এই ব্যবস্থা।
রাতের সৌন্দর্য
শ্রীমঙ্গলে রাতের সৌন্দর্য দেখে একেকজন যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, কী অপূর্ব স্নিগ্ধ রাত! আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ, সেই আলোয় পশ্চিম পাশের টিলার ওপরের চা–বাগান এক অদ্ভুত সৌন্দর্য হয়ে ধরা দিচ্ছিল। ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকার ওড়াউড়ি। এ যেন অপার্থিব সৌন্দর্য। সুবাহানাল্লাহ্, মন থেকে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া জানিয়ে মস্তক অবনত হয়ে যাচ্ছিল।
আমরা প্রকৃতির অপরূপ রূপে নিজেদের হারিয়ে বড্ড চুপচাপ বসে ছিলাম কটেজের বারান্দায়। মাঝেমধ্যে তক্ষক ডেকে উঠছিল, কখনোবা শিয়ালের ডাক; পরিবেশটা কেমন যেন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার।
চা–কন্যাদের শহরে এসে বোধ হয় সত্যিকার অর্থে প্রকৃতির শিখরে পৌঁছে গেলাম। কটেজের বারান্দায় বসে চাঁদ দেখা, হাতে শ্রীমঙ্গলের চা নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার অনুভূতি অনন্য। জানা যায়, শ্রীমঙ্গলে প্রথম চা–বাগান স্থাপিত হয় ১৮৫৭ সালে। আজও এখানকার চা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য।
চা–শ্রমিকদের জীবন
পরদিন আমরা সিএনজিচালক স্থানীয় কামাল ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। শ্রীমঙ্গলের অজানা সৌন্দর্য দেখার ইচ্ছা থেকে, নির্দিষ্ট পর্যটন পয়েন্টগুলো বাদ দিয়ে আমরা ঘোরার সিদ্ধান্ত নিই।
কামাল ভাই আমাদের পেয়ে খুশি হলেন। আমাদের নিয়ে গেলেন ভেতরের দিকের চা–বাগানে, যেখানে চা–পাতা সংগ্রহের প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। চা–শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম।
ওদের জীবনযাপনের বিষয়গুলো জেনে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। শ্রমিকদের মুখে ছিল না কোনো হাসি, চোখে শুধুই ক্লান্তি ও অনিশ্চয়তার ছাপ। তাঁদের জীবন যেন কোনো এক কষ্টদায়ক পথ; যে পথ পাড়ি দিতেই হয়, যেখানে টানা কাজ আর আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যেই বেঁচে থাকা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে গোটা একটা দিন রোদে শুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মূল্য মাত্র ১৭০ টাকা। বুকের ভেতর কিছুই করতে না পারার একটা যন্ত্রণা চাপা দিয়ে আমরা আরও সামনে এগিয়ে গেলাম।
কামাল ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন একটি আনারসের বাগানে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সারিবদ্ধ আনারসের বাগানগুলো দূর থেকে দেখতে অন্য রকম সুন্দর। সেখানে বাগান থেকে নিয়ে আমরা পাকা আনারস খাওয়ার সুযোগ পেলাম। শ্রীমঙ্গলের আনারস যে এত সুস্বাদু মিষ্টি, স্বাদের সঙ্গে অপূর্ব ঘ্রাণ হয়, আমার আগে জানা ছিল না।
জীবন সম্পর্কে ভাবনা
এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চায়ের মিষ্টি সুর, সারা দিনের শীতল বাতাস, শান্ত পানি—সব মিলিয়ে এক মহাজাগতিক মায়ায় আমাদের মন ঢেকে গেল। বোধ হয় সে জন্যই পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়তেন বিশ্ব বিখ্যাত মনীষীরা, শিখতেন জীবনের মর্মার্থ, জানতেন কেন প্রকৃতি তার নীরব ভাষায় মানুষকে জ্ঞানের অসীম আকাশে পৌঁছাতে সাহায্য করে। বিশ্বকে চেনাতেন নতুন করে, অর্জিত সেই জ্ঞান পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে ধাপে ধাপে।
শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ শেষে মননে গভীর শান্তির অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসার পর বুঝতে পারলাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা জায়গায় গিয়ে, প্রকৃতির শুদ্ধ রূপ দেখতে না গেলে, জীবনের এক বড় অভিজ্ঞতা মিস করা হতো। এখানে গিয়ে প্রকৃতির স্পর্শে হৃদয়ের কোথাও একটা কোণায় নিজেকে আবিষ্কার করা যায়। জীবনের দিকে তাকানো যায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, যা আমার জন্য একধরনের উপলব্ধি—আমরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কিন্তু প্রকৃতি আমাদের খুব ভালো শিক্ষক হতে পারে।
আমার কাছে ভ্রমণ মানে শুধু জায়গা পরিবর্তন নয়, এটি জীবনের গভীর অনুভূতি ও শিক্ষা। আপনি যদি মানসিক শান্তি ও নতুন কিছু জানার খোঁজে বের হন, তবে শ্রীমঙ্গল সত্যিই আপনার জন্য আদর্শ স্থান। এই ভ্রমণ আপনাকে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যই দেখাবে না, বরং জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সহায়ক হবে। প্রতিদিনের ব্যস্ততার মধ্যে কিছু সময় বের করে একবার শ্রীমঙ্গল ঘুরে আসুন—বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে এটি একটি।
কিছু প্রয়োজনীয় কথা
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগে। সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল বা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বাসে যাওয়া যায়। হানিফ, শ্যামলী, সিলেট এক্সপ্রেস, মৌলভীবাজার সিটি এবং অন্যান্য পরিবহনে বাস সার্ভিস পাওয়া যায়। ভাড়া এসি বাসে ৮০০ টাকা, নন-এসি বাসে ৩৫০ টাকা। ট্রেনেও যাওয়া যায়। তবে সে ক্ষেত্রে ৫-৬ দিন আগে টিকিট কেটে রাখতে হয়, নাহলে ভোগান্তির শিকার হতে পারেন এবং ট্রেনও না–ও পেতে পারেন।
শ্রীমঙ্গলে রাতযাপনের জন্য বেশ কিছু রিসোর্ট আছে। এর মধ্যে আমরা অনলাইনে দেখেশুনে আগেই একটি রিসোর্টে কথা বলে রেখেছিলাম। আসলে ঘুরতে যাওয়ার আগে সেই স্থান সম্পর্কে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার অভ্যাস বলা চলে। এতে অনেক কিছু জানা যায় এবং একজন পর্যটক হিসেবে অচেনা জায়গায় ভ্রমণে গিয়ে তেমন কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না।