ছেলেবেলা থেকেই অদ্ভুত রকমের বৃক্ষপ্রেমী আমি। অবশ্য বৃক্ষপ্রেমী না বলে গাছপাগল বললেও খুব একটা অবিচার করা হবে বলে মনে হয় না। এদের সঙ্গে অদৃশ্য মায়ার বাঁধন রয়েছে, যা প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করতে পারি। বৃক্ষপ্রেমের জন্য পাড়ায় ঢের বদনামও আছে আমার। পাড়ার অনেকেই পাগল বলে আখ্যায়িত করেন।
মনে পড়ে, শৈশবে যখন খেলার ছলে নিজেদের বাড়ি বানাতাম; তখন বন্ধুরা ইটের টুকরা, পাটকাঠি—এসব দিয়ে বাড়ি বানালেও আমি তাদের উল্টো পথে হাঁটতাম। ইতিউতি থেকে শিকড়সমেত রং-বেরঙের বুনো গাছ-লতাপাতা তুলে এনে, সেগুলো পুঁতে বাড়ি বানাতাম। পানি ঢেলে গাছগুলোর সঙ্গে বাড়িটাকেও করে তুলতাম জীবন্ত। সেখানে একা শুয়ে-বসে থাকতাম, বই পড়তাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি; যা লিখে প্রকাশ করার মতো শব্দ আমার ঝুলিতে নেই।
একটা সময় আমার রুমেও নানাবিধ গাছের আনাগোনা ছিল। পড়ার টেবিল, বুক শেলফ, ওয়্যারড্রপ, ড্রেসিং টেবিল, জানালার ধার—এসব জায়গায় সংসার পেতে বসেছিল তারা। নিয়ম করে তাদের গা ধুয়ে দিতাম, পানি ঢালতাম, রাতবিরেতে গল্প করতাম।
আমরা মানুষেরা অতিমাত্রায় নিষ্ঠুর। যে গাছের ছায়ায় বসি, যে গাছের ফল খাই, সেই গাছেরই পাতা ছিঁড়ি, ডাল ভেঙে নিয়ে যাই।
আমার নিঃসঙ্গতা দূর করার সঙ্গী গাছ। গাছের সঙ্গে কথা বলি। মনে হয়, ওরা আমাদের ভালোবাসা বুঝতে পারে; শুনতেও পারে। যদি এসব না–ই হতো, তাহলে ওদের সঙ্গে থেকে, কথা বলে এত শান্তি লাগে কেন? আমার মতো অনেকেই গাছের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের ভালোবাসা বুঝতে পারেন।
আমি বাসায় লাল শাপলা, পদ্ম ও কচুরিপানা লাগাই। আমার ভাতিজা মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন গাছের পাতা, ফুল-ফল এনে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা কাকা, এটা কী গাছ?’ ওর ধারণা, আমি সব গাছের নাম জানি। যখন ফুল-পাতা দেখে গাছের পরিচয় দিই। ও বলে, ‘আমি জানতাম তুমি পারবে। তাই তোমাকে দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছি।’ গাছের প্রতি ওর আগ্রহ দেখে মনে শান্তির ছোঁয়া লাগে। পৃথিবীর ফুসফুস সুস্থ রাখতে এমন প্রজন্মই প্রয়োজন।
জাপানবাসী আমার এক বন্ধু আছে। গাছের প্রতি এমন পাগলামী দেখে, সে আমাকে জাপানের ফুল, প্রকৃতি আর গাছের ছবি পাঠায়। কী অদ্ভুত সুন্দর সেসব বৃক্ষরাজি, ফুল আর প্রকৃতি! চেরি ফুল এবং অটোমান ট্রির রঙিন পাতা মুগ্ধতা ছড়ায়।
এক একটা গাছ এক একটা ভালো বন্ধুর মতো—যারা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে জানে। পুরোনো গাছের প্রতি আমার আলাদা একটা টান আর কৌতূহল কাজ করে। গাছগুলোর শরীর ছুঁতে ছুঁতে মনে হয়, তারা কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কতশত সুখ-দুঃখের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কত সকাল, কত ক্লান্ত দুপুর আর সন্ধ্যার গল্প বুকে পুষে রেখেছে। গাছের যদি মানুষের মতো কথা বলার ক্ষমতা থাকত, তাহলে তারাও আমাদের নানি-দাদিদের মতো গল্পের ঝুলি খুলে বসত—আমরা তাদের চারপাশে গোল হয়ে বসে সেসব গল্প শুনতাম।
আজকাল মানুষের গাছ নিয়ে ভাবার সময় নেই। তারা গাছপালা কেটে অট্টালিকা, মিল-কারখানা আর রাস্তা তৈরিতে মত্ত। যখন পত্রিকায় দেখি, শতবর্ষী গাছ কেটে এই করা হচ্ছে সেই করা হচ্ছে, তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। গাছগুলোর জন্য কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা বিবেককে তাড়িয়ে বেড়ায়। গাছপালা ধ্বংস করে স্থাপনা সুন্দর করার পক্ষে কখনই ছিলাম না। বরং তাদের পক্ষে যারা গাছপালা বাঁচিয়ে স্থাপনাকে সুন্দর করে তুলে।
আমাদের একটা খেজুরবাগান ছিল। বাগানের প্রতিটি গাছ দাদার-নানার হাতে লাগানো। এই বাগানে দাদা থেকে শুরু করে আমাদের এমনকি পাড়ার অনেক মানুষের সোনালি স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। খেজুরের মৌসুমে কাকডাকা ভোরে খেজুর কুড়ানো ছিল আমাদের দিন শুরুর প্রথম কাজ। পাড়ার ছেলেমেয়েরা প্রতিযোগিতা করে খেজুর কুড়াতাম। বাগানে যে আগে যেত, তার দখলে থাকত সবচেয়ে বেশি খেজুর। অন্যদের কপালে জুটত পাখির আধখাওয়া খেজুর। অবশ্য সেই সময় সেটাও অমৃত ছিল। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতাম—‘শালিক ভাই! শালিক ভাই! একটা খেঁজুর দে।’ যখনই পাখির ঠোঁট ফসকে খেজুর নিচে পড়ত, হুমড়ি খেয়ে পড়তাম সেই খেজুরের উপর আর বলতাম—‘পাখি আমাদের কথা শুনেছে।’ তারপর সেই কুড়ানো খেজুর মক্তবে গিয়ে অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে খেতাম।
কিছুদিন আগে বাড়ি গিয়ে ভীষণ মর্মাহত হয়েছি। ব্যবসায়িক উদ্দেশে বাগানের প্রত্যেকটি খেজুরগাছ কেটে, ড্রেজার দিয়ে মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। অথচ চাইলে গাছগুলো না কেটেই কাজ করা যেত। কিন্তু আমরা যে ধ্বংসলীলায় বিশ্বাসী, তাই আমাদের মাথা থেকে সংরক্ষণের চিন্তারা ছুটি নিয়েছে।
যেবার পাড়ার মোড়ের সবচেয়ে বয়সী গাবগাছটি আগুনের তাপ সইতে না পেরে একটু একটু করে মরে যাচ্ছিল, তখন ওর মরে যাওয়া দেখে ভেতরে ভেতরে আমিও মরে যাচ্ছিলাম। পূর্ব পুরুষদের অনেক কাছ থেকে দেখেছে এই গাছটি। যাঁদের আমরা দেখিনি বা চিনি না, তাঁদেরও দেখেছে সে, তাঁদেরও চেনে। শুনেছি আটাশির বন্যায় এই গাবগাছের মস্ত বড় এক ডাল কেটে রাস্তার ভাঙন ঠেকানো হয়েছিল। কী অদ্ভুত না! যে রাস্তার ভাঙন ঠেকানোর জন্য তার অঙ্গ কাটা গেল, এতগুলো বছর পর সেই রাস্তা সংস্কারের পিচ পোড়ানো আগুনে জীবন দিতে হলো তাকে!
আমরা মানুষেরা অতিমাত্রায় নিষ্ঠুর। যে গাছের ছায়ায় বসি, যে গাছের ফল খাই, সেই গাছেরই পাতা ছিঁড়ি, ডাল ভেঙে নিয়ে যাই।
ব্লক-জি, বনশ্রী, ঢাকা