জহির রায়হানের স্বপ্ন ‘জীবন থেকে নেয়া’

জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়া ছবির দৃশ্য। কালজয়ী এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার আমজাদ হোসেন

মাত্র ৩৬ বছরের জীবনে জহির রায়হান দেশের জন্য লড়াই করে গিয়েছেন, দেশকে ভালোবেসে, দেশের মুক্তির জন্য স্বপ্ন ও স্বাধীনতার বীজ বুনে গিয়েছেন। তীব্র যন্ত্রণা এবং আপসহীন লড়াই জারিত সৃষ্টিশীলতার কথা জানলে মন ভরে যায়। মাথা নত হয়ে আসে। তাঁর সৃষ্টির পরতে পরতে দেশের মাটির কথা, পরাধীন দেশের মানুষের জীবনের কথা। নিজের এবং নিজেদের জীবন থেকে নেওয়া গল্প, সাবলীল বুনে যাওয়া লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র মাধ্যমে সেসব কথা বলে গিয়েছেন।

১৯৭০ সালে মুক্তিযুদ্ধের ঠিক এক বছর আগে মুক্তি পায় জহির রায়হানের রচনায় ও পরিচালনায় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক দেড় মাস পরে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি হারিয়ে যাওয়া ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। সৃষ্টিশীল মানুষ—এই দুই ভাই দেশকে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছেন।

‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে স্বনামে অভিনেতা আনোয়ার হোসেনকে আমরা দেখতে পাই, সাথি ও বীথির দাদার চরিত্রে, যিনি দেশ অন্তঃপ্রাণ। তাঁর প্রতিটি সংলাপে শুধু দেশ আর দেশ। এই সংলাপ শরীরে কাঁটা দেয়। চোখে জল নিয়ে আসে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তাঁকে আত্মহারা করে। পরাধীন দেশের প্রতিটি লড়াই-আন্দোলনে তিনি শামিল। অগ্রপথের পথিক। দেশের জন্য মাঝেমধ্যে জেলে যেতে হয়।

সাথি ও বীথির চরিত্রে মিষ্টি দুই বোন সুচন্দা ও রোজী সামাদ; পরিচারক মধুকে নিয়ে তাঁর সংসার। মধু গোটা পরিবারকে আগলে রাখেন। মধু চরিত্রে আমজাদ হোসেন। এই চলচ্চিত্রের মর্মস্পর্শী প্রতিটি সংলাপ আবার এই আমজাদ হোসেনের রচিত। মধু প্রথম দিকে ঘর, সংসার, পরিবার ছেড়ে আনোয়ার ভাইয়ের শুধু দেশ নিয়ে পড়ে থাকা প্রতিটি কথার সমালোচনা করলেও, একসময় নিজেও মানুষের বাঁচার লড়াই-আন্দোলনে, মিছিলের মুখ হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানি ঘাতক শাসকদের নির্বিচারে হত্যা-গুলিতে প্রাণ দেন।

সাথির সঙ্গে অন্য এক পরিবারের বড় ভাই আনিসের বিয়ে ঠিক হয়। এই চরিত্রে অভিনয় করেন শওকত আকবর, পেশায় উকিল। সেই পরিবারের ছোট ছেলে ফারুক চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক। যিনি দেশের জন্য লড়াই করেন। ফারুকের সঙ্গে অবশ্য সাথির ছোট বোন বীথির আগে থেকেই কলেজে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আনিস আর ফারুকের বাড়ির কর্ত্রী বড় দিদি রওশন জামিল। চরিত্রটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বড় দিদির ভয়ে তাঁর স্বামী থেকে শুরু করে দুই ভাই, বাড়ির চাকর পর্যন্ত সবার পায়ের তলায় মাটি কাঁপে। সবাই ভয়ে অস্থির। তিনি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক পরিবার চালান। নিজে যা বলবেন, সেটাই শেষ কথা। পান থেকে চুন খসলে, নাকের ওপর মাছি উড়লেও কামান দাগেন। একটি ঘরের শাসকের মাধ্যমে গোটা পরাধীন দেশের শাসনব্যবস্থাকে ফুটিয়ে তোলেন পরিচালক।

এই বড়দির নিরীহ গোবেচারা স্বামী পেশায় উকিল হলেও গানপাগল একজন মানুষ। অভিনয়ে খান আতাউর রহমান। বাস্তবে এই চলচ্চিত্রের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন বিশিষ্ট এই অভিনেতা ও সংগীত পরিচালক। দেশের জন্য প্রতিটি গান অনবদ্য, হৃদয়ের একূল-অকূল জাগিয়ে দেয়। একুশের প্রভাতফেরির আবহমান কালের চিরন্তন সেই গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি..’ ব্যথিত উদার, শোককাতর চিত্তে পায়ে-পায়ে আমাদের মনের মিনারে নিয়ে যায়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি..’ পরাধীন দেশে প্রথম চলচ্চিত্রায়িত হয়। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’, জেলখানার রাজবন্দীদের কণ্ঠে আন্দোলিত হয়। অন্য গানগুলোও সুন্দর, যথাযথ মূল্যায়িত হয়েছে। কণ্ঠ দিয়েছেন অজিত রায়, মাহমুদুন নবী, সাবিনা ইয়াসমীন, নীলুফার ইয়াসমীন, খন্দকার ফারুক আহমেদ ও খান আতাউর রহমান নিজে।

চলচ্চিত্রের গল্পে যাচ্ছি না। আমাদের মা-ঠাকুমার শাড়ির আঁচলে চিরকালীন যে চাবির গোছা থাকে, সেই চাবির গোছাকে এই চলচ্চিত্রে অসাধারণ রূপকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। একটি পরিবারের চাবির গোছা কার হাত থেকে কার হাতে যাবে? শেষ পর্যন্ত দেশের চাবি দেশের মানুষের হাতে আসবে কি না, তার প্রতিযোগিতা, সংঘাত, অন্তঃকলহ, রাজনীতি এবং পরিণতি গল্পে এগিয়ে যায়।

ঘরকে স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত করতে হলেও লড়াই দরকার। দেশকে মুক্ত করতে হলেও অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্ত দরকার। দেশের মাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে হয়। আনোয়ার হোসেনের চোখমুখের সংলাপ এই চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য। আমাদের আবেগতাড়িত করে।

জহির রায়হান বেশ মজার এবং রসিক মানুষ ছিলেন যে তা এই চলচ্চিত্রের কৌতুক উদ্দীপক দৃশ্য দেখেই বোঝা যায়। দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল, কঠোর, কঠিন, পরমব্রতী ছিলেন। পাকিস্তানি আমলে বসে তাঁর সব সৃষ্টিকর্ম। কম বয়সে নিজে নিখোঁজ হয়ে গিয়েও তাই আমাদের জন্য অনন্য সৃষ্টিসম্ভারের খোঁজ রেখে গেছেন।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত