মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠস্বর; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতিকে দিয়েছিল এক সর্বাত্মক যুদ্ধের নির্দেশনা। এই যুদ্ধের ‍প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

শুরুতেই পাকিস্তান ছিল এক গোঁজামিল রাষ্ট্র। মাঝখানে বিশাল ভারত। এরই পূর্ব-পশ্চিমে দুই মুসলিম ভূখণ্ড নিয়ে সৃষ্টি পাকিস্তান। দুই পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব হাজার মাইলের বেশি। পূর্ব বাংলাসহ পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে তৈরি হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। প্রতিটি প্রদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক, খাবার আলাদা। এমনকি মানুষের চেহারাও আলাদা। অথচ কেবল ধর্মের জন্য গড়ে উঠল এমন এক রাষ্ট্র।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রে কিছু মৌলিক নীতি থাকবে। এই রাষ্ট্রে সব নাগরিক সমান মর্যাদা পাবে। হিন্দু-মুসলিম, ধর্ম, ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভিত্তিতে কেউ পরিচিত হবে না। মানবিকতার জন্য সবাই এক হবে। জাতীয় জীবনে এটা মনে রাখতে হবে।

জিন্নাহ নিজে যেমন এই নীতি মনে রাখেননি, তেমনি তাঁর অনুসারীরাও এটা মনে রাখেনি। তাঁদের শাসন ছিল ইতিহাসের নিষ্ঠুর রাজাদের মতো। প্রায় ২৪ বছর অত্যাচার সহ্য করতে করতে এ দেশের মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। একসময় অনিবার্য হয়ে ওঠে এই শাসকগোষ্ঠীর পতন।

সাতচল্লিশে দেশভাগের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য রক্ত ঝরে। এ আন্দোলন মুক্তির পথ দেখায় বাঙালিকে। পাকিস্তানের সব প্রদেশে নির্বাচন হয়। হয় না কেবল পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইলে এক উপনির্বাচন ছিল। সে নির্বাচনে প্রার্থী হন আওয়ামী লীগের শামসুল হক ও মুসলিম লীগের খুররম খান পন্নী। নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় হয়। এর পর থেকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় নির্বাচন থেকে সরে যায়। ভাষা আন্দোলন থেকে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রাম। অবশেষে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আকাশছোঁয়া বিজয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে শুরু করে ইতিহাসের বর্বর গণহত্যা। বাঙালির কাছে যা ছিল, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্লজ্জ মিথ্যাচার করত। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণার পরই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু বেতার থেকে এ সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল। তারা বলেছিল, শেখ মুজিবুর রহমান ‘একটি গোপন বেতার’ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন ইত্যাদি। সেদিনের সেই গুপ্ত বেতার হলো ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।’ এই বেতার কেন্দ্র তখন দেশে-বিদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
ফাইল ছবি

এই কেন্দ্র ছিল যুদ্ধের প্রথম সাংগঠনিক উদ্যোগ। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তাদের প্রতিরোধ করার যেন কেউ নেই। কিছুই করতে পারবে না বাঙালিরা। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতিকে দিয়েছিল এক সর্বাত্মক যুদ্ধের নির্দেশনা। এই যুদ্ধের ‍প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ছিল নানা সৃষ্টিশীল অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে বুনেছে স্বপ্ন। এই কেন্দ্র অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে সাহস জুগিয়েছে এক হার না মানা অধ্যায় রচনার।

ইয়াহিয়া খান লেলিয়ে দিয়েছে হানাদার বাহিনী। তারা নির্বিচার হত্যা করছে মানুষ। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি দিশাহারা। চারদিক অন্ধকার। এ যেন মৃত্যুর মুখে নীরব দর্শক। এমন একটা পরিস্থিতিতে পথ দেখিয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

কী দুর্বার শক্তি ছিল এই কেন্দ্রের। স্বাধীনতার আজ এত বছর পরও সেটা কল্পনা করাও কঠিন। এই কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনামাত্র অনেকে অশ্রু ধরে রাখতে পারেনি। সে অশ্রু ছিল শত্রুর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর, শত্রুকে প্রতিহত করার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার এক অনন্য ঘটনা। এই বেতারের কণ্ঠস্বর আলোড়ন তুলেছিল বাঙালির মনে। দেখিয়েছিল ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। সেই ভয়াবহ দুঃসময়। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণে এই বেতার ছিল যেন বাতিঘর। বুলেটের মতো ছিল এর এক একটি শব্দ। সবার ভাবনা এক করে দিয়েছে বেতার থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা। আর কোনো বিকল্প নেই স্বাধীনতা ছাড়া। এবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যুদ্ধে। জাতিকে সংগঠিত করা অত্যন্ত জরুরি। বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই মুহূর্তে দিশাহীন বাঙালি সংগঠিত হতে থাকে।

তখন সময় ছিল এমন যে অনেক খবরই জানা যেত না। আবার জানতে পারলেও অনেক সময় চলে যেত। এমন একটি কঠিন সময় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তারপরও সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের খবর দ্রুত দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্বাধীনতাসংগ্রামের পুরোটা সময় ধরে প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের শক্তি জুগিয়েছে বাংলার নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের।

২৫ মার্চ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এ কেন্দ্র। প্রথম এই বেতারই পাকিস্তানি স্বৈরশাসককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। এর কণ্ঠযোদ্ধারা প্রচণ্ডভাবে ভেঙে দিয়েছিল ইয়াহিয়ার দম্ভ। একই সঙ্গে পৃথিবীকে আহ্বান জানিয়েছিল বাংলাদেশকে তাৎক্ষণিক সমর্থন, স্বীকৃতি ও সহযোগিতা দিতে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য কণ্ঠস্বর হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। যুদ্ধ জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এই বেতার। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অমর হয়ে থাকবে। মানবসভ্যতায় আর কোনো বেতার কেন্দ্র এত বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানা নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা।

লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক