দুটি কথা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রিয় ত্রিণা,

কেমন আছ? আশা করি, ভালো আছ। তবে আমি ভালো নেই, মনটা ভীষণ খারাপ। প্রকৃতিতে শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে যেমন শুষ্কতা বিরাজ করে, আমার মনের অবস্থাও ঠিক তেমন। ফাটা ঠোঁটের মতো মনও ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

নিজের প্রতি চরম বিরক্তি আসে মাঝেমধ্যে। আমি সাধারণ পরিবারের সদস্য। আমার স্বপ্ন থাকবে প্রচুর অর্থ আয়ের দিকে। সৎ কিংবা অসৎ পথে, ন্যায়-অন্যায় যেভাবেই হোক; অর্থ উপার্জনই আমার মূল্য লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। তা না, আমার ভালোবাসা জাগ্রত হয় প্রকৃতির প্রতি। ভালো লাগে শিল্প–সাহিত্যের সঙ্গে সময় কাটাতে, গবেষণা করতে, বই পড়তে, একা একা গান করতে, বুক রিভিউ কিংবা গল্প লিখতে। এসব একদমই মানায় না আমায়। অ্যাকাউন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করা মানুষ আমি; ডেবিট–ক্রেডিট বিশ্লেষণ করে লাভ-ক্ষতি আর সম্পদ ও দায়ের পাশ মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বছরের মতো নিজের প্রতিটি বছরের হিসাব রাখা উচিত। তা না করে আমি ভালোবাসি ভ্রমণ, মানুষের সঙ্গে কথোপকথন, নিজের চিন্তায় ভিন্ন কিছু তৈরি করা নিয়ে, যা সত্যিই বেমানান ও সাংঘর্ষিক।

এই পুঁজিবাদী সমাজে যেখানে অর্থের মূল্যই সব, সেখানে আমি প্রাকৃতিক মূল্য খুঁজে হয়রান হয়ে যাই। পুঁজিবাদ সমাজে বেমানান এক পণ্য হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। এ রকম চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকতে ভালো লাগে না বলে নিজেকে বড্ড অসাড় মনে হয়। মনে হয় এই জগতে আমি অতিরিক্ত ভোগ করা ব্যক্তি। অপ্রয়োজনে প্রাকৃতিক অনিয়মের বাইরে হয়তো চলে এসেছি এই ধরায়। চিন্তাধারার আধুনিক বৃদ্ধির বদলে আমার হ্রাস হচ্ছে আরও দ্রুতগতিতে। না পারছি নিজেকে বোঝাতে, না পারছি এসব পরিস্থিতি মেনে নিতে।

তুমি প্রায়ই বলো, আমি খুব সাধারণ এবং সাধারণ চিন্তা করি বলেই তুমি আমায় পছন্দ করো। কিন্তু সত্যি জানো ত্রিণা, আমার এসব বৈশিষ্ট্য মাঝেমধ্যে গলার কাঁটা মনে হয়। এমন সাধারণ চিন্তা দিয়ে জীবন চলে না। একদমই না, সংসার তো নয়ই। তাই হয়তো আমার সংসার করা হবে না কখনো। সাংসারিক মারপ্যাঁচগুলো গণিতের সরল অঙ্ক কিংবা ক্যালকুলাস থেকেও জটিল মনে হয়। তৈলাক্ত মাথায় তেল দেওয়া সমাজে আমি নিজেকে এই কাজে দক্ষ করে তুলতে পারিনি। ভয়াবহ রকম মিথ্যা প্রশংসা করে নিজের সুবিধা আদায় করে নিতে শিখিনি। আমার শুধু মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা ভুল করে ভুল কোডিং বসিয়ে আমাকে ভুল জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন না মিলছে কোড, না বের হচ্ছে ফলাফল। মাঝখানে জীবনটা বেরসিক আর দুর্বিষহ হয়ে যাচ্ছে।

আমার এই লেখাগুলো তোমার কাছে জটিল বিশ্লেষণ মনে হলেও এটাই আমার বর্তমান উপলব্ধি। এর থেকে বের হয়ে স্রোতে গা ভাসাতে আমি পারছি না বলেই চরম অস্বস্তিকর একটা জীবন আমাকে পার করতে হচ্ছে। বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে, তবু আমার অকার্যকর চিন্তাধারা শেষ হচ্ছে না। লস প্রজেক্টের চিন্তা করে করে জীবন ক্ষয় হচ্ছে যত্রতত্র।

তোমাকে নিয়ে আমি ভাবি না। তুমি ভালো জায়গায় আছ। সেখানে নিজের মতো নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারবে। এর থেকে বড় স্বস্তি আর হতে পারে না। আজ রাখি, ইচ্ছা না হলে হয়তো দীর্ঘ বিরতি নিয়ে তোমায় চিঠি লিখব। সে পর্যন্ত ভালো থেকো।

ইতি,
তোমার হৃদয়
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

হাজীপুর, নরসিংদী