পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। রাস্তাঘাট জনশূন্য, খাঁ খাঁ করছে চারদিক। ঈদুল ফিতর চলে গেল, ঈদুল আজহা নিকটে। কারও মনে আনন্দের লেশমাত্র নেই। পৃথিবীর সবকিছুই যেন থমকে গেছে। মানুষের বিষণ্নতা প্রকৃতিকেও মলিন করে দিয়েছে। কিন্তু শফিকের মায়ের হৃদয় ভেতরে ভেতরে ঠিকই পুড়ছে। আর্তনাদ করে বেড়াচ্ছে ছেলের জন্য।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল,
‘হ্যালো মা, আমি শফিক। ভালো আছি। তুমি ভালো আছ তো?’
‘হ্যাঁ, বাবা। আল্লায় রাখছে ভালোই। তুই বাড়ি ফিরবি কবে বাবা? আক্কাস যে বাড়িত আইছে। তোর বুঝি ছুটি দেয় না?’
‘মা, তোমার ছেলের এখন অনেক দায়িত্ব। শিগগিরই এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে তোমার ছেলে তোমার কোলে ফিরবে। সাদা পাড়ের সুন্দর একটা শাড়ি কিনেছি মা।’ বলেই কাশতে লাগল।
‘হ্যালো, বাবা, হ্যালো.... ’
গত কয়েক দিন ধরেই কাশি, জ্বর, বমি বমি ভাব তার।
কিছুদিন হলো শফিকের বিয়ে হয়েছে। পাশের গ্রামের লতার সঙ্গে প্রেমের বিয়ে। স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোর আগেই তাকে কর্মস্থলে ফিরতে হলো। বিয়ের আগে বেশ চনমনে স্বভাবের ছিল লতা। বিয়ের পরেও হইহুল্লোড় করে একাই মাতিয়ে রাখত বাড়ি। সেই মেয়েটা আজকাল নির্বাক। যেন কথা বলতেই জানে না। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে রাত হয়। পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে সে। সব সময় অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবতে থাকে।
পুরো গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শফিকের বন্ধু আক্কাসের নাকি করোনা হয়েছে! ছেলেটার ভাইবোন, বাবা কেউ তার ধারে–কাছে ঘেঁষে না।
আক্কাসদের বাড়ি যাওয়ার পথে জানালা দিয়ে শফিকের মা দেখে পুরাতন ছেঁড়া একটা মলিন কাঁথা মুড়িয়ে আক্কাস শুয়ে আছে। পাশেই বিষণ্ন হয়ে বসে আছে তাঁর মা। শ্বাস নিতে পারছে না ছেলেটা, জোরে জোরে চিৎকার করছে। কপালে জলপট্টি দিতে দিতে তার মা বলছে, ‘কিছু হবে না বাবা। দেখিস, আল্লাহ তোরে সুস্থ করে দেবে।’
শফিকের মায়ের নীরবে অশ্রু ঝরছে। সন্তানের জন্মদানের মুহূর্তে যে মায়ের জীবনের প্রদীপটুকু শতভাগ নিভে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে না, সেই মা কি পারে সন্তানের এই দুর্দিনে ছেড়ে যেতে?
বৈশাখের দুপুর বেলার তপ্ত রোদে উত্তপ্ত ধরণীর ধূলি। লতা অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে উঠানের দাওয়ায়। এমন সময়ে পুলিশের গাড়ির সাইরেন। সবাই ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। শফিকের মা অগ্রসর হয় পুলিশ দেখার জন্য। এই পোশাকই যে তাঁর ছেলে পরিধান করে।
দেখল পুলিশের গাড়িটা তাঁদের বাড়ির দিকেই আসছে। শফিকের মা আনন্দে আত্মহারা। পরমুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। গাড়ি থেকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা বের করা হচ্ছে। কাছে যেতেই শফিকের মা চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফিরতেই ক্রন্দনরত অবস্থায় ক্ষীণ করুণ সুরে বলে উঠল, ‘খোকা, এই বুঝি আমার সাদা পাড়ের শাড়ি!’
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়