মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রফিক; একটি বিস্মৃত অধ্যায়

তথ্য সংগ্রহের সময় শহীদ রফিকের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ (ডানে)ছবি: লেখকের সৌজন্যে

একাত্তরের বীরসেনা শহীদ মো. রফিক আহমেদের জন্ম পটিয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝের ঘাটার নূর আহমদ সওদাগরবাড়িতে। পিতার নাম মৃত ছদর আলী সওদাগর ও মাতা মৃত আসমা খাতুন। শহীদ রফিক ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ছদর আলী সওদাগরের চার ছেলে ও এক মেয়ে। আবদুর রাজ্জাক, আবদুল মালেক, মো. রফিক আহমেদ, আবদুস সোবহান ও নূরজাহান বেগম।

শহীদ রফিক ছোটবেলা থেকে বেশ দুরন্ত। মাঝের ঘাটা মাতিয়ে রাখতেন। ফুটবল ছিল প্রিয় খেলা। কৈশোরে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে হই–হুল্লোড় করে ছুটে বেড়াতেন সমগ্র পটিয়ায়। বেশ সাহসী ও শৌখিন বন্ধুদের প্রিয় ছিলেন। কারও মন খারাপ থাকলে গান শুনিয়ে মন ভালো করে দিতেন। সব সময় সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন।

স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে বাঁকখালী গ্রামের পশ্চিম বিলে চড়ুইভাতি আয়োজন করতেন। বাঁকখালীর বাঁকে জাল ফেলে মাছ শিকার করতেন। জোছনাভাঙা রাতে গানের আসর বসাতেন পুকুরঘাটে। গ্রীষ্মকালে দল বেঁধে পুকুরে ডুবসাঁতার, কখনো ফুটবল, কখনো দাঁড়িয়াবান্ধা, বউছি, কানামাছি খেলতে খেলতে বেলা কাটিয়ে দিতেন।

শহীদ রফিকের বোন নূরজাহান বলেন, ‘সেজ ভাই রফিককে আমি কুলো বলে ডাকতাম।’ এ সময় শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন তিনি, চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছিল। রফিক তাঁর বোনকে নিয়ে গুন গুন করে গান গাইতেন, ‘তুই আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন।’ নূরজাহান বলতে থাকেন, ‘কুলো ভাই শহীদ হওয়ার বছর দুয়েক আগে বাবা মারা যান। ভাইদের আদর-স্নেহে বড় হয়েছি। বড় ভাইয়েরা বাবার অভাববোধ হতে দিতেন না। ভাইয়ার বয়স তখন ২৭-২৮ হবে, টগবগে যুবক। বন্ধুদের সঙ্গে একাত্তরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। কেউ বলে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে চড়কানাই গ্রামে বলী খেলা দেখতে যেতেন। বোনের বাড়িতে আসলে অনেক বন্ধুবান্ধব ঘুর ঘুর করত। বারেক চেয়ারম্যানের বলী খেলা, মেলা, নানা আউলিয়াদের বার্ষিক উরস শরিফে রাতভর আড্ডা দিতেন। আসাদগঞ্জে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত প্রসারিত করতে কৃপণতা করতেন না। কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে দাঁড়াতেন। সেজ ভাইয়ের বিয়ের কথাও ঠিক হয়েছিল মামাতো বোন কাঞ্চনী বেগমের সঙ্গে। সেজ ভাইয়ের পছন্দ ছিল। ভাইয়ের হাতে আর মেহেদি লাগানো হলো না। তার আগে আমাদের ভাই পাকিস্তানিদের হাতে শাহাদতবরণ করেন।

‘রফিক ভাইয়ের শহীদ হওয়ার পর আমরা ভাইয়ের রক্তমাখা শার্টটি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ি। ভাইয়ার রক্তমাখা শার্ট দেখে মা বিলাপ করতেন, আমি কী নিয়ে বাঁচব, আল্লাহগো, মা গো, তোরা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেরে বাবা। মায়ের ক্রন্দনধ্বনি পুরো মাঝেরঘাটা এলাকায় শোনা যেত। একসময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। দিনের পর দিন পুত্র হারানো শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একসময় শেষের ঠিকানায় পাড়ি জমান।’

শহীদ রফিকের বোন নূরজাহান বেগম (ডানে)
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

শহীদ রফিকের খালাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ। বয়সে রফিক তাঁর ছোট ছিলেন। ভাইয়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘ছেলেবেলা থেকে আমরা একসঙ্গে চলাফেরা করতাম। রফিক সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাদের কমান্ডার ছিলেন প্রফেসর শামসুল ইসলাম। রফিককে আমরা রউফ্যা বলে ডাকতাম। সে ছিল বেশ সুদর্শন, লম্বা। দেখলে তাকে যে কেউ মনে করবে বিদেশি ফুটবলার। খেলার মাঠে পড়ে থাকত। ব্যবসার টাকাপয়সার বেশির ভাগই ফুটবল টিমের পেছনে ব্যয় করত। উদারমনা ছিল। বেশ শৌখিনও ছিল। গলায় একটা স্বর্ণের চেইন পরত। রাহাত আলী স্কুল ফুটবল টিমের জন্য বেশ সহযোগিতা করত। সবাই তাকে পছন্দ করত।’

শহীদ রফিকের বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল হক বলেন, ‘রফিক পোশাক-আশাকে বেশ পরিপাটি ছিল। লুঙ্গি ও গোলাকার গেঞ্জি পরিধান করত। যুদ্ধের সময় কাপ্তাই যাওয়ার পথে লিচুবাগান এলাকায় আমার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। বন্ধু রফিক ফিরে আসেনি। পাক বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করে।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ বলেন, ‘একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কিবরিয়া, দুলাল, লতিফ, আবদুল মান্নান, সালেহ আহমেদ, শহীদ রফিকসহ আমরা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বরকল হয়ে ভারতের জন্য মূলত কাপ্তাইয়ের রাজস্থলী এলাকায় প্রবেশ করি। মাঝপথে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এক চাকমা আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দেন। একসময় আমরা রাজস্থলী উপজেলায় প্রবেশ করি এবং রাজস্থলী বাজারের কাছে একটি প্রাইমারি স্কুলে অবস্থান করি।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, ‘১৯৭১ সালের কথা। খুব সম্ভবত জুন মাসের প্রথম দিকে আমরা পাঁচ বন্ধু দ্বিতীয়বারের মতো বগাফার উদ্দেশে রওনা দিই মুক্তিযুদ্ধের জন্য কিছু গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে। সে সময় রাজস্থলী বাজারের কাছে একটি প্রাইমারি স্কুলে (বর্তমানে রাজস্থলী বাজার সরকারি মডেল প্রাইমারি স্কুল) আমরা বিশ্রাম ও রাতযাপনের জন্য অবস্থান করি। ভারতের বিতর্কিত মিজু আর্মি, যারা পাকিস্তানিদের দোসর হিসেবে কাজ করত; তারা পাক বাহিনীর কাছে আমাদের তথ্য ফাঁস করে দেয়। পাঞ্জাবিরা তখন রাজস্থলী বাজার এলাকা ঘিরে ফেলে। কিছু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ২৫০ জনের বেশি পাকিস্তানি আমাদের ঘিরে ফেলে স্কুলের জানালা দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। আমরা সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করি এবং পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হই। কেউ কেউ পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযোদ্ধা সালেহ আহমদ ছল্লা কুপিবাতি নিভিয়ে দিলে অনেকে পালিয়ে বেঁচে যান। সম্মুখযুদ্ধে রফিক গুলিবিদ্ধ হয়। তার শরীরে অন্তত সাতটা গুলি লেগেছিল। আমাদের চোখের সামনে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সেদিন ফজরের নামাজের পরে রাজস্থলী এলাকার স্থানীয় লোকজন ছোট পরিসরে জানাজা পড়ে বাজারের কাছাকাছি একটি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করেন।’

পটিয়া পৌরসভার মাঝের ঘাটা এলাকায় শহীদ রফিকের নামে ‘শহীদ রফিক স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাইকপাড়া কালো ফকিরের দোকানের পাশ দিয়ে যে সড়কটি মাঝের ঘাটার দিকে চলে এসেছে, সেটির নামকরণ করা হয়েছিল শহীদ রফিকের নামে। সড়কটির নামফলক একসময় কালের বিবর্তনে হরিয়ে যায়। পটিয়া উপজেলা পরিষদ মাঠের পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিস্তম্ভের পাশে দেয়ালের পেছনে পটিয়ার শহীদ তালিকার মধ্যে ৩ নম্বরে শহীদ রফিকের নাম মার্বেল পাথরে খোদাই করে লেখা আছে।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা