একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুব

বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুবের সঙ্গে লেখকছবি: লেখকের সৌজন্যে

২০১৫ সালের কথা। দৈনিক আজাদীতে শহীদ ছবুরকে নিয়ে আমার লেখা ‘যুদ্ধ শেষে যে ছেলেটি বাড়ি ফেরেনি’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। লেখাটি একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুব পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। আমাকে মুঠোফোনে সেটা জানান। তিনি বললেন, ‘রশীদ এনাম, আমি শহীদ ছবুরের বন্ধু ও সহযোদ্ধা।’ ওনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় সেটাই। পরে জানলাম, তিনি আমার স্কুলবেলার বন্ধু পাভেলের বাবা। সেই সূত্রে ওনাকে আমি চাচা বলে ডাকি।

একদিন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার চৌধুরী মাহবুব শোনালেন যুদ্ধদিনের গল্প।

জন্মকথা ও পরিবার: মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী সবার কাছে চৌধুরী মাহাবুব নামে পরিচিত। ১৯৫৪ সালে ৬ জুন পটিয়া পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড উত্তর গোবিন্দারখীল গ্রামের হাদু চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত আবদুল আলিম চৌধুরী। মাতা রাবেয়া খাতুন চৌধুরানী। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চৌধুরী মাহাবুব সবার বড়।

২৬ মার্চ পটিয়া কলেজ এলাকায় ইপিআর সদস্যরা অবস্থান নেয়। তাঁদের জন্য রান্না ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয় আবদুর রহমান বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।

শিক্ষা ও কর্মজীবন: পড়ালেখার হাতেখড়ি উত্তর গোবিন্দারখীল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ ভূর্ষি উচ্চবিদ্যালয় হতে এসএসসি এবং ১৯৭৩ সালে পটিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীন নিরাপত্তা পরিদর্শক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

ছাত্ররাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ: ’৬৯-এর দশক থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতিতে আসার পেছনে যাঁদের অনুপ্রেরণা সব সময় পেয়েছেন, তাঁরা হলেন প্রয়াত এস এম ইফসুফ, সাবেক সংসদ সদস্য মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, সাংবাদিক জালাল উদ্দিন, সৈয়দ আহম্মদ, আহমদ নূর, সাবেক শিল্পমন্ত্রী অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, সুলতান আহম্মেদ কুসুমপুরী, চাচা খালেক, মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী, আহম্মদ নূর সওদাগর (পটিয়া আদালত রোডে যাঁর দোকানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন), চৌধুরী সিরাজুল ইসলামসহ অনেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর চৌধুরী মাহাবুব ছাত্রলীগ এবং পরবর্তী সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন।

১৯৭১ সালের যুদ্ধদিনের কথা বলতে গিয়ে চৌধুরী মাহাবুব বলেন, ৭ মার্চের ভাষণের পর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। আমির ভান্ডার দরবার শরিফে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতিমূলক গোপন বৈঠক হতো। ওখানে আ ক ম শামসুজ্জামানসহ অনেকে থাকত। সে সময় আমি ছাত্রলীগের কর্মী। ‘দিশারী’ ও ‘কান্ডারী’ নামে দুটি গ্রুপ ছিল। কান্ডারীর নেতৃত্ব দিতেন শহীদ গাজী আবদুস ছবুর। দেখতে দেখতে এল ২৫ মার্চের কালরাত। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কাছে শুনতে পাই, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। পাকিস্তানিরা পাগলা কুকুরের মতো মরণ কামড় শুরু করে দিয়েছে। চারদিকে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অত্যাচার–নির্যাতন থেকে নারী, শিশু, আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ বাদ যাচ্ছে না। চারদিকে হত্যাযজ্ঞ। লাশের মিছিল। পচা লাশের গন্ধে অনেক সময় নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসত।

পটিয়া থানা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদকে আহবায়ক করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ২৬ মার্চ পটিয়া কলেজ এলাকায় ইপিআর সদস্যরা অবস্থান নেয়। তাঁদের জন্য রান্না ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয় আবদুর রহমান বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। তালতলা চৌকির ইসমাইল সওদাগর, যিনি সুচক্রদণ্ডী ইউনিয়নের একসময়ের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি এসব তদারক করতেন। ইপিআর সদস্যদের জন্য খাবার সংগ্রহ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা করতাম আমি। ইপিআর সৈনিকদের কাছ থেকে শহীদ ছবুরসহ আমরা অনেকে রাইফেল চালানো শিখি। এদিকে ২৭ মার্চ থেকে স্থানীয় তরুণ, ছাত্র-যুবকদের সহায়তায় ইপিআর সদস্যরা কালুরঘাটে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষে৵ পটিয়া থেকে একটি গ্রুপ ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার উদ্দেশে পটিয়া অ্যাগ্রিকালচার স্টেট থেকে রওনা দিয়ে নাজিরহাট  কলেজ হয়ে রামগড়ে পৌঁছাই। রামগড়ে আগে থেকে অবস্থান করছিলেন এস এম ইউসুফ, মোখতার আহমদ, সুলতানুল কবির চৌধুরীসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। সেখান থেকে ৮ এপ্রিল বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা প্রায় ১০০ জন ছাত্রের একটি দল ভারতের বগাপা বিএসএফ প্রশিক্ষণকেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হই। এ গ্রুপটি প্রথম মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়।

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জেনে মা-মাটি ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে। দেশকে সমৃদ্ধিশালী ও বিশ্বের দরবারে মান–মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে।

চৌধুরী মাহাবুব বলতে থাকলেন, ৯ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৭ এপ্রিল গাজী আবদুস ছবুরসহ রামগড় হয়ে অধ্যাপক এ বি এম শামসুল ইসলামের (প্রথম গ্রুপ কমান্ডার) নেতৃত্বে দেশে ফিরে আসি। আসার পথে চোখে পড়ে খালের পানিতে ভাসছে বেশ কিছু বিকৃত পচা–গলা লাশ। বাতাসে লাশের গন্ধ মিশে একাকার। সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যাই আমরা। সবার মধে৵ প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল। তখনো রামগড়ের পতন হয়নি। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে সবাই পটিয়ায় অবস্থান করছিলাম। এর মধ্যে তৎকালীন সরকার দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর জন্য এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দেয়। যুদ্ধকালীন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি আলহাজ সাইফুল আলম মাসুদ সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করি। ঠিক সে সময় দেখা হয় তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আনোয়ারের সঙ্গে। আনোয়ার সাহেব পরিচয় করিয়ে দেন বাহুলীর বাসিন্দা বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট শামসুল আলমের সঙ্গে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আনোয়ার আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য পরীক্ষাকেন্দ্রে গ্রেনেড হামলা চালানোর পরিকল্পনার কথা বলেন।

মাসুদ সাহেবের মা বেগম গুল চেমন আরাকে মা বলে ডাকতাম। তিনি আমাদের ভাত খেতে দেন। খাওয়ার পর আনোয়ার গামছা দিয়ে দুজনের কোমরে গ্রেনেড বেঁধে দেন। দুজন মিলে রাহাত আলী স্কুলের সামনের মাঠে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটাই। গ্রেনেড বিস্ফোরণের কথা শহীদ আবদুস ছবুর আগের দিন তাঁর চাচা গাজী আমিন শরিফ সাহেবের বাসায় বসে চাচাতো ভাইবোনদের জানায়, পটিয়ায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ করা হবে। এটিই ছিল পটিয়া সদরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম অপারেশন।

পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে যান। কিছুদিন পর সুবেদার মেজর টি এম আলী গ্রুপের হাবিলদার ফজলুর নেতৃত্বে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে খানমোহনা রেলস্টেশনে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেই আক্রমণে ছিলেন শহীদ ছবুর, মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমদ, মরহুম আবুল কালাম, মরহুম কবির আহমেদ, নাসির, আহমেদ ছফাসহ অনেকে। গাইড হিসেবে ছিলেন সোবহান। এই অপারেশনে তিনজন রাজাকার মারা যায়। রাজাকার ও পাকিস্তানি আলবদর বাহিনীর অত্যাচার ভোলার মতো নয়। জুন-জুলাই মাসে মধু মহাজনের বাড়ি ও শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর বাড়িতে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা আগুন দেয় এবং ব্যাপক লুটপাট চালায়। লোকজন প্রাণ বাঁচানোর জন্য এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে। সে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য। যাওয়ার সময় রাজাকাররা মধু মহাজনকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে সহযোগিতা পাওয়ার কথা না বললেই নয়। অনেকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। গোবিন্দারখীল মকবুল আহমেদের বাড়ি, দক্ষিণ ভূর্ষি অপূর্ব চৌধুরীর বাড়ি, কেলিশহর ছায়াবিশ্বের বাড়ি, হাইদগাঁও বৈদ্য বাড়ি ও হাজির মাঠে (মোস্তাক বিল্লা) পূর্ব দরগার পাশে অনেক মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিত। এলাকার অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কষ্ট করে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।

১৯৭১ সালে ১৩ ডিসেম্বর আবু সৈয়দ গ্রুপ, মহসিন খান গ্রুপ ও ইসলামাবাদী গ্রুপসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসে পটিয়া পাকবাহিনী মুক্ত হয়। হাইদগাঁওয়ের আবু সৈয়দ (পটিয়া কলেজের একসময়কার পদর্শক ও আইনজীবী) দলে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী বিতাড়িত হওয়ার পরে পটিয়ায় সাধারণ মানুষ আনন্দমিছিল করেন। ডিসেম্বরের শেষের দিকে সবাই মিলে মহসিন গ্রুপ ও আবু সৈয়দ গ্রুপ পটিয়া জমিরিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান করছিলাম। ওই সময় ইন্ডিয়ার মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন পি কে  মল্লিক ট্রামকারে করে পটিয়া এলে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সব অস্ত্র জমা নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে রওনা দেন।

আগামী প্রজন্মের উদ্দেশে চৌধুরী মাহাবুব বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জেনে মা-মাটি ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে। দেশকে সমৃদ্ধিশালী ও বিশ্বের দরবারে মান–মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে।’

লেখক ও গবেষক