দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যস্ততম নগরী খুলনার ফুলতলা উপজেলার একটি গ্রাম দক্ষিণডিহি। মূল শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে ফুলতলা উপজেলা। সেখান থেকে দুই কিলোমিটার ভেতরে গেলেই দক্ষিণডিহি গ্রাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণডিহির সম্পর্কের শুরু তাঁর মাতা সারদা সুন্দরী দেবীর সূত্রে। সারদা সুন্দরী দেবী দক্ষিণডিহির রামনারায়ণ রায় চৌধুরীর কন্যা। সম্পর্কের শুরুটা মামাবাড়ির সূত্রে হলেও ১৮৮৩ সালে দক্ষিণডিহির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নতুন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২৪ অগ্রহায়ণ ১২৯০ বঙ্গাব্দ (রোববার, ইংরেজি ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩) রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দক্ষিণডিহির বেণীমাধব রায় চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণী দেবীর শুভ বিবাহ হয়।
রবি ঠাকুর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে আছেন। দুঃখ-আনন্দ সবকিছুতেই তাঁর স্পর্শ অনুভব করি। ঘুমের ওষুধ যেমন ঘুমের উদ্রেক করে, রবীন্দ্রসংগীতও তেমনি জীবনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। আরও বেশি প্রশান্তি অনুভব করি, যখন রবীন্দ্র–স্মৃতিবিজড়িত কোনো স্থান পরিদর্শনে যাই। অনেকের মতো দল বেঁধে ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। সময়-সুযোগ হলে ‘একলা চলো’ ব্রত নিয়েই বেরিয়ে পড়ি।
সেদিন এক আত্মীয়ের মুখে কবিগুরুর শ্বশুরবাড়ি সম্পর্ক জেনে ফুলতলার দক্ষিণডিহি গিয়েছিলাম। ছবির মতো সাজানো–গোছানো সুন্দর গ্রাম। যত দূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। পাখির কলকাকলিতে চারপাশ মুখর। রাস্তার পাশ ধরে নাম না জানা বিবিধ গাছে ফুটে আছে অজস্র ফুল। প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে। কবিগুরু ‘প্রজাপতি’ কবিতায় বলেছেন, ‘সকালে উঠেই দেখি/ প্রজাপতি একি/ আমার লেখার ঘরে,/ শেলফের ‘পরে/ মেলেছে নিস্পন্দ দুটি ডানা—/ রেশমি সবুজ রং, তার ‘পরে সাদা রেখা টানা।’ পঙ্ক্তিগুলো মনে পড়তেই ভ্যান থামিয়ে নির্নিমেষ চোখে প্রজাপতিদের দেখতে লাগলাম। কথায় আছে, সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। একইভাবে জীবনও নদীর মতোই গতিশীল, প্রয়োজন ব্যতীত মানুষও মানুষের জন্য অপেক্ষা করে না। গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য প্রত্যেকেই সমান ব্যস্ত। ভ্যানের অন্য যাত্রীরা বিরক্ত বোধ করতে পারেন, মনে হতেই পুনরায় ভ্যানে উঠে পড়লাম। গ্রামের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা দুই কিলোমিটার পিচের রাস্তা পাড়ি দিয়ে কবির শ্বশুরবাড়ি এসে পৌঁছাই।
আমার ক্লান্তি নিবারণে, নাকি স্বাভাবিক নিয়মে জানি না, বৃষ্টি শুরু হলো। মেঘহীন আকাশের সাদা বৃষ্টি। রাস্তার ধারের ছোট্ট দোকানের ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। চারদিকে প্রকৃতির মোহনীয় রূপ। সবুজ ঘাসের ওপর ছমছম ছন্দে বৃষ্টি পড়ছে, আকাশের বুকে সূর্যের তেজোদ্দীপ্ত উপস্থিতি। এক দর্শনার্থী মিউজিক প্লেয়ারে গান শুনছেন, ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে/ তোমারি সুরটি আমার মুখের প’রে, বুকের প’রে।’ প্রার্থনার মতো পরিবেশ, শরীরজুড়ে এক অপার্থিব ভালো লাগার শিহরণ অনুভব করলাম। প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবির শ্বশুরবাড়ি পরিদর্শনে দর্শনার্থীরা আসেন। তবে কবির জন্মদিন ও মৃত্যুদিনকে কেন্দ্র করে দর্শনার্থীর ভিড় কিছুটা বাড়ে। এখানে কবির জন্মদিন ও মৃত্যুদিন নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়।
শ্বশুরবাড়ির মূল ফটকের পাশেই টিকিট কাউন্টার। ভেতরে প্রবেশের জন্য টিকিট নিতে হবে, মূল্য ১০ টাকা। ভেতরে প্রবেশ করতেই পিচ বসানো কয়েক মুহূর্তের হাঁটাপথ। দুই ধার দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সারি সারি ছোট গাছ। তারপরই শ্বশুরবাড়ির মূল ভবন। ভবনটির প্রবেশমুখে এক পাশে রবীন্দ্রনাথ ও আরেক পাশে ভবতারিণী দেবীর আবক্ষ মূর্তি।
শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন শেষে তিনটি সিঁড়ি অতিক্রম করে ভবনের বারান্দায় উঠলাম। প্রশস্ত বারান্দা, চারপাশ থেকে ফুরফুরে হাওয়া আসে। দোতলা ভবনটির নিচতলায় রবি ঠাকুরের বিভিন্ন সময়ের ছবি, চিত্রকর্ম, মৃণালিনী দেবীর ছবি ও একটি পাঠকক্ষ (লাইব্রেরি) রয়েছে। পাঠকক্ষে বইয়ের তাকে রবীন্দ্র রচনাবলির পাশাপাশি রবীন্দ্র গবেষণামূলক বেশ কিছু গ্রন্থও চোখে পড়ল। ছবি ও চিত্রকর্ম ঘুরে দেখার সময় চোখ আটকালো একটা ছবিতে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বয়সের ছবি একত্র করে ফ্রেমবন্দী করা। একজন দর্শনার্থীর সৌজন্যে ছবিটা সম্বন্ধে বিশদ জানতে পারি। ভদ্রলোক ক্রমানুযায়ী গুরুদেবের কোন ছবিটি কোন বয়সের, ব্যাখ্যা করলেন। এরপর ওপরে ওঠার নান্দনিক সিঁড়ি বেয়ে ভবনের দোতলায় গেলাম।
দোতলার শুরুতেই একটি বড় কক্ষ। এখানেও রয়েছে অনেক ছবি। কবিপত্নী ভবতারিণী, অর্থাৎ মৃণালিনী দেবীর একটি ছবিতে চোখ পড়ল। বড় কলেবরের একটি ছবি, নিচে কবিগুরুর বিখ্যাত গানের একটি চরণ, ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।’ এরপরই বারান্দা। দোতলার খোলা বারান্দা, চারপাশে নান্দনিক নকশার রেলিং দেওয়া। সম্পূর্ণ কমপাউন্ডটা এখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায়। উঠানে বিবিধ রকম ফুলের গাছ, পাখিরা কিচিরমিচির করছে। ভবনের চারপাশে অনেক জায়গা, সবুজ ঘাসের সমারোহ। দেখলে মনে হবে, কেউ যেন সবুজ কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে। কয়েকজন দর্শনার্থী গলা মিলিয়ে বারান্দায় বসে গান গাইছিলেন। যন্ত্র ছাড়া রবির গান, অতীব চমৎকার কণ্ঠ। একজন শিল্পী আমাকেও তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হতে বললেন। গুরুদেবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে গলা মিলিয়ে গান গাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে—/ জীবন মরণ সুখ-দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।’
অপার আনন্দ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে একটি ব্যানারে চোখ পড়ল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভবতারিণী দেবীর বিয়ের পূর্বে এখানে বেণীমাধব রায় চৌধুরীর একটি দোচালা টিনের ঘর ছিল। বিয়ের পর দোচালা টিনের ঘরটি ভেঙে দোতলা দালান তৈরি করা হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে বাড়িটি পুনরুদ্ধার করে জাতীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে ‘রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’ নামকরণ করা হয়। পাশাপাশি সাহিত্যানুরাগী ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে ভবনটির গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৯৯ সালের ১৮ নভেম্বর কমপ্লেক্সটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।