বড় রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে ডান পাশে ফুলের বাগান, তার ঠিক সামনেই একটি দোতলা ভবন। উপর তলায় অফিস, নিচের তলায় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়। প্রতিদিনের মতো গতকালও হেঁটে ফিরছি। সন্ধ্যা তখনো হয়নি, ভবনটির সামনে পৌঁছাতেই কানে এল, ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই’। গান আমাকে মুগ্ধ করে। জীবনের পথেপ্রান্তরে ঝরে যাওয়া ফুলের মতো অন্তলীন বিষাদগুলোতে মায়ার আস্তরণ লেপে দেয়। সুরের জাদু এখানেই, মূহূর্তে মনকে ভরিয়ে তোলে।
হঠাৎ মনটা ভারী হয়ে এল। সহস্র সংগ্রাম ও কত জীবনের বিনিময়ে বাংলা ভাষা ও আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। অসংখ্য বঞ্চনা, শোষণ ও নির্যাতনের শেষে আজকের এই স্বাধীনতা। পথটা মোটেই সহজ ছিল না। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্রমে এগিয়ে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অপেক্ষা কেবল নতুন সূর্য উদিত হওয়ার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অকুতোভয় বীর বাঙালির কাছে পরাজয় নিশ্চিত জেনে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা আঁটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের বরেণ্য সন্তান বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তারা। কেবল এ দিনই নয়, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত এবং এর আগে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা মুহূর্তে ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ঘাতক বাহিনী।
আজ ১৪ ডিসেম্বর। দৃঢ় বেদনার দিন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। তাঁদের স্মরণ করতে নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিনটি। শিক্ষার্থীরাও সেই উদ্দেশ্যে গতকাল প্রস্তুতি নিয়েছে। গান শেষ হলে ভালো লাগা থেকেই ভেতরে গিয়ে বসলাম। স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী, তাদের চোখেমুখে সূর্যালোকের মতো উজ্জ্বল প্রভা। বুকভর্তি স্বপ্ন-আশা। একাগ্রচিত্তে অনুশীলন করছে সবাই। কেউ কবিতা, কেউ গান, কেউ নৃত্য, কেউবা বক্তৃতা বিষয়ে অনুশীলন করছে। একজন শিশুশিক্ষার্থীর আবৃত্তি শুনে বিস্মিত হলাম, ‘আমি জন্মেছি বাংলায়/ আমি বাংলায় কথা বলি/ আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।’ ‘আমার পরিচয়’ সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা। পরিচয়ের জন্যই তো ছোট থেকে বড় হওয়া। তবে একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে তাঁর ভাষা ও মাতৃভূমি। যা জন্মগতভাবেই একজন মানুষ প্রাপ্ত করে। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আমাদের ছিল না। এই পরিচয় অর্জনের জন্য আমাদের জোগাতে হয়েছে বহু মূল্য। ভাইয়ের-বোনের রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে বাংলার আকাশ, বাতাস ও মাটি। তাই তো সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ, প্রিয় মাতৃভূমি গৌরবে, সৌরভে বিশ্ব বিধৌত।
আবৃত্তি শেষে চারদিকে আনন্দের ঐকতান ছড়িয়ে পড়ল। শিক্ষার্থীরা সমস্বরে গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একে অপরের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে সহযোগিতার হাত। এমন একটি দিনের স্বপ্নই তো দেখেছিলেন বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। যখন ছোট থেকেই ছেলেমেয়েরা সব ধরনের অধিকার নিয়ে বড় হবে। মায়ের ভাষায় পড়বে, খেলবে, ছুটে বেড়াবে। শোষণ, বঞ্চনা নয়, ভালো লাগা ও ভালোবাসার পথ ধরে বড় হবে।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা স্বপ্ন দেখতেন সমৃদ্ধ স্বাধীনদেশের। মা, মাটি, ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করে আমরা এগিয়ে গেলেই তাঁদের স্বপ্ন সার্থক হবে। তাই দৃঢ় বেদনার দিন হোক শপথের, প্রত্যয়ের। শুধু একটি মাত্র দিন নয়, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা হোক প্রত্যহ স্মরণীয়। তাঁদের স্বপ্ন, আশা, আদর্শ হোক আমাদের পথচলার শক্তি ও অনুপ্রেরণা।