সম্পর্কের টানাপোড়েনে জীবনসংসার এগিয়ে চলে। ভাঙাগড়ার এই জগৎ সংসারে কখন কী হয়, নিয়তিতে কী লেখা থাকে, তা কেউ বলতে পারে না। তবু মানুষ স্বপ্ন দেখে, মনে আশা জাগ্রত হয়, প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজের সব চাওয়া পূর্ণ করতে। কিন্তু সব সময় তা হয়ে ওঠে না। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে, মানুষ নিমিত্তমাত্র।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মানবজমিন’ উপন্যাসটি এগিয়ে গিয়েছে মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা মানুষের জমানো কথার সুন্দর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। মানুষ সারা জীবনের মধ্যে খুব কম সময় পায় নিজেকে প্রকাশ করতে। নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত বাসনা বা স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ করতে। সামাজিকতা, পারিবারিক দায়বদ্ধতা, ব্যক্তিসংকোচসহ নানা পরিস্থিতি বাধা সৃষ্টি করে গতিকে রুদ্ধ করার জন্য।
রতনপুরের শ্রীনাথবাবু এত বড় বাড়িতে থেকেও নিজেকে অসহায় অনুভব করে। নিজের বউ তৃষার প্রতি তীব্র ঘৃণা তাকে শেষ করে দেয় প্রতিনিয়ত। শ্রীনাথ পালাতে চায় বহুদূরে কোথাও, নিজের সামর্থ্যে করা জমিতে থাকতে চায়। এই সম্পত্তি তার বড় ভাই মল্লিনাথের। সবাই রটে বেড়ায়, বেঁচে থাকতে মল্লিনাথের সঙ্গে তৃষার একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল, যার ফলস্বরূপ তাদের ছেলে সজল আর এসব সম্পত্তি ভাশুর মল্লিনাথ লিখে দিয়ে যায় ছোট ভাইয়ের বউ তৃষাকে।
রতনপুর গ্রাম ছেড়ে ট্রেনে মানুষ কলকাতা পাড়ি জমায় জীবিকার তাগিদে। তাদের মধ্যে শ্রীনাথও একজন। শ্রীনাথদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে এক বোন বিলু। বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। বিলুর স্বামী প্রীতম অসুস্থ। জীবন–মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। তাদের একটি মেয়েও আছে। প্রীতম মরতে ভয় পায় না। সে অসুস্থ এটাও মানতে চায় না। সে বাঁচতে চায়। অরুণের সঙ্গে বিলুর লুকোচুরি কিংবা প্রকাশ্য একটা সম্পর্ক চলছে। প্রীতম এটা বুঝেও কিছু বলতে পারছে না।
দীপনাথ বা দীপু এক ভিন্ন চরিত্রে এখানে উপস্থিত হয়েছে। এই উপন্যাসের নায়কও বলা যায় তাকে। যে কোনো দিন গভীরভাবে কোনো মেয়েকে ভালোবাসেনি। অফিসের বস মিস্টার বোসের স্ত্রী মণিদীপার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। তবে সবশেষে দীপু বুঝতে পারে এটা ভালোবাসা না, নিছক চাওয়া। নিজের প্রথম শারীরিক চাহিদা পূরণ করেছিল সুখেন নামের মেসম্যাটের শয্যাসঙ্গিনী বীথির সঙ্গে। যে বীথিকে প্রথম দেখায় মনে হয়েছে এই মহিলাকে দীপু ভালোবাসতে পারে, যার তীব্র আকর্ষণ সে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। তাই তার বিছানার সঙ্গী হয়েছে কয়েকবার। দুই কিশোর বয়সের সন্তানের মা বীথির বয়স মোটামুটি হলেও নিজের গায়ের রং, শারীরিক গঠন আর ফিটফাট থাকা তার বয়স লুকাতে সহায়তা করেছে। দীপনাথের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। সে মিস্টার বোসের পিএ থাকা থেকে সেই কোম্পানির ম্যানেজার পদে পদোন্নতি পেয়েছে। পরে এই চাকরি ছেড়ে বহুজাতিক কোম্পানিতে জয়েন করে। বেতনও বৃদ্ধি পেয়েছে, পেয়েছে সুযোগ–সুবিধাও। চলে যাচ্ছে আমেরিকায়।
প্রীতমের ভাই শতম কলকাতা থেকে তাকে নিজেদের বাড়ি শিলিগুড়ি নিয়ে যায়। সেখানে প্রীতম সুস্থ হয়ে ওঠে। একদিন প্রীতম নিজেই পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। কোথায় গিয়েছে, সে খোঁজ আর কেউ পায়নি। হয়তো প্রীতম তার নিজের মতো করে হারিয়ে গেছে।
তৃষা, বিলু, মণিদীপার ভূমিকা চিরচেনা সমাজে নারীর অবস্থানের বিপরীতে ফুটে উঠেছে। অবলা নারী প্রচলিত কথা থেকে নারী শক্তির ভিন্ন ভিন্ন রূপ আর ব্যক্তি ব্যবস্থাপনা সমাজের মানুষের কটূক্তি ভুলে এখানে স্বাধীন রূপ পেয়েছে।
জমিনের বিভিন্ন ফসলের মতো এই মানবজমিনেও বিভিন্ন সময় একেক জীবনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের এক জীবনে নানা পরিস্থিতিতে নানাভাবে বিকশিত হতে হয়, এটা প্রকৃতিই ঠিক করে দেয়। মানুষ পরিণত হয় পরিস্থিতির বেড়াজালে আটকে পড়ে। তবু মানুষের ছুটে চলা অফুরন্ত থাকে।
একনজরে
বই: মানবজমিন
লেখক: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
প্রকাশনী: আনন্দ পাবলিশার্স
প্রকাশক: সুবীরকুমার মিত্র
প্রথম প্রকাশ: আগস্ট ১৯৮৮
মূল্য: ৩০০ টাকা