হারানো প্রিয়তমার সন্ধান দেন যে ‘দয়াল মুরশিদ’

‘দয়াল মুরশিদ’ চলচ্চিত্রসংগৃহীত

নিটোল একটি ভক্তিবাদের চলচ্চিত্র, ১৯৭৩ সালে নির্মিত রূপসনাতনের ‘দয়াল মুরশিদ’। ভক্তিবাদের পথে সুন্দরের সাধনায় দীর্ঘ একটি যাত্রা। মূলত ইসলাম ধর্ম দর্শনের ভিতের ওপর গড়ে উঠলেও সব ধর্মের সমন্বয়ের মূল বার্তা মানুষের মধ্যে ঈশ্বর সন্ধানের কথা উঠে এসেছে এ চলচ্চিত্রে।

মানুষের মধ্যে প্রাণের ঈশ্বর, প্রেমের ঈশ্বরের বাস। যুগে যুগে ভক্তিবাদ তাই সহজিয়া প্রেমের সাধনা। বড় বড় কেতাবি জ্ঞানেও যা মেলে না, লোভী অসৎ এক শ্রেণির ভণ্ড তপস্বী, অসাধুদের ভুল পথের বাগাড়ম্বরেও যা মেলে না; একমাত্র হৃদ্‌মাঝারে সৎ গুরু শিষ্যের ভাবের আদান-প্রদানে যার বিস্তার।

আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে দেখেছি দেব-দেবীর লোককথা, লোকাচারনির্ভর সুসাহিত্যের জন্ম হয়েছে। মূলত মানুষের মনের ভয় থেকে চলমান জীবনযাপনের বাস্তবতায় এসব দেব-দেবীর জন্ম। মানুষ চোখের সামনে সূর্য, অরণ্য, বনাঞ্চল, সর্প যা কিছু দেখেছে; যাদের সুফল ও কুফলের দ্বারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আক্রান্ত বা প্রভাবিত হয়েছে, সবাইকে দেবতা বানিয়েছে। আদি কবিরাও সেসব দেব-দেবীকে নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন।

মানুষ যখন ঈশ্বর ঈশ্বর করে উন্মাদ হয়ে নিজের সবকিছু সঁপে দিয়েও ঈশ্বরের দর্শন পায় না, ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ঈশ্বর নিজেই এসে নাকি তখন ধরা দেন। পথের শেষে পথ বাতলে দেন। সব ধর্মের মানুষেরা এই কথাগুলো বিশ্বাস করেন।

আবার মধ্যযুগে এসে দেখলাম, দেব-দেবীর প্রতি অন্ধবিশ্বাস কিছুটা কমে এসেছে। মানুষ নিজের শক্তিতে সব কিছুকে জয় করার ক্ষমতা রাখতে শুরু করেছে। ফলে, একদিকে অলৌকিক দেব-দেবী, বিমূর্ত সত্তার মধ্যে ঈশ্বরে বিশ্বাস, অন্যদিকে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা মানুষেরা, মানুষের জীবনধারা কাব্য–সাহিত্যে বড় ভূমিকা রাখতে শুরু করে। রূপসনাতনের ‘দয়াল মুরশিদ’ ১৯৭৩ সালে নির্মিত হলেও সেই ধারার একটি সুন্দর প্রতিফলন। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তের অগাধ বিশ্বাস আর মর্ত্যের লীলাধামে জগতের সুর ও অসুরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব।

এ ধরনের প্রবল ধর্মবোধ থেকেও তো পৃথিবীতে অনেক মহৎ সুন্দর শিল্পসাহিত্যের জন্ম হয়েছে। এই সৃষ্টিশীল ধর্মবোধে প্রাধান্য পেয়েছে মানবতাবাদ। প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম থাকলেও বা সেই ধর্মের অনুসরণকারী হলেও বিভেদ বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে সবাই একই ঈশ্বর বা আল্লাহর সন্তান—মনে ও মননে এই বিশ্বাস সবাইকে সাধনার পথে এগিয়ে দিয়েছে।

‘দয়াল মুরশিদ’ চলচ্চিত্রের একেবারে শেষ দৃশ্যে দেখি ধর্মপ্রাণ হাসান গুরুর নির্দেশে এক পতিতাপল্লিতে গিয়ে তার নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ প্রাণপ্রিয়াকে খুঁজে পাচ্ছে। বিয়ের পর বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার নদীপথে জলদস্যুরা স্বামীকে মেরে পানিতে ফেলে দিয়ে স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। হাসানকে উদ্ধার করেছে এক জেলে। সেই জেলে পরিবার শুশ্রূষা দিয়ে হাসানকে বাঁচিয়ে তুলে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই প্রিয়তমা শিরিনকে খুঁজে পেতে হাসান উদ্‌গ্রীব, একপ্রকার উন্মাদ হয়ে ওঠে। নদীর কূল থেকে অজ্ঞাতপরিচয় মানুষকে তুলে নিয়ে আসা, তার সেবা–শুশ্রূষা করা—এই পর্যায়ের সঙ্গে লালন ফকিরের জীবনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

ধার্মিক হাসানের এই শিরিন প্রেমের, হারানো ব্যথার মধ্যে আমরা রামচন্দ্রের সীতাকে হারানোর মর্মব্যথাও উপলব্ধি করতে পারি। উন্মাদ হাসান বনজঙ্গলে শিরিনের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। ফণা তুলে উঁকি দেওয়া সাপকেও জিজ্ঞাসা করে, তুমি আমার শিরিনকে দেখেছ? বাঘকেও নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুমি শিরিনকে দেখেছ? রামচন্দ্রও এভাবে মণিহারা ফণী হয়ে সামনে যাকে পায় তাকেই সীতার সন্ধান জিজ্ঞাসা করত এবং সীতার জন্য বিলাপ করত। প্রবল ধর্মবোধ থেকে উঠে আসা এই কাল্পনিক বিষয়গুলোও রূপকথার গল্পের মতো আনন্দ দেয়। সব ধর্মের গল্প কিছু কিছু জায়গায় এসে অবিকল মিলে যায়।

আবার হাসানের এই শিরিনকে খুঁজে চলার মধ্যে আমরা একপ্রকার ঈশ্বরকে খুঁজে চলার কথাও ভাবতে পারি। লালন যেভাবে আরশিনগরে পড়শি, মনের মানুষের সন্ধান করতেন। প্রাণপ্রিয়া শিরিনের মধ্যেই যে হাসানের সৃষ্টিকর্তার বাস। এই ঈশ্বরের সন্ধান সহজে মেলে না। অনেক সাধনায় কখনো হঠাৎ মিলে গেলেও নিয়তি লিখনে আবারও হাত ছাড়া হয়ে যায়।

আবার মানুষ যখন ঈশ্বর ঈশ্বর করে উন্মাদ হয়ে নিজের সবকিছু সঁপে দিয়েও ঈশ্বরের দর্শন পায় না, ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ঈশ্বর নিজেই এসে নাকি তখন ধরা দেন। পথের শেষে পথ বাতলে দেন। সব ধর্মের মানুষেরা এই কথাগুলো বিশ্বাস করেন। এখানেও দেখলাম, হাসান একজন সাধক গুরুর সন্ধান পেয়েছে। সেই গুরু একসময় হাসানের মর্মব্যথা দূর করে, প্রবল ঈশ্বর বিশ্বাস অটুট রেখে প্রিয়তমার সঙ্গে মিলনের পথ বলে দেন। পতিতা গৃহে গিয়ে সেই ঈশ্বরের সন্ধান পাওয়া এই কথাও বুঝিয়ে দেয়—মানুষ হিসেবে কেউ ঘৃণ্য নয়, ছোট নয়।

হাসান চরিত্রটি এমনই, অন্যের দুঃখে কেঁদে ওঠে তার মন। পথের ধারে কষ্ট পাওয়া কুষ্ঠরোগীকে ছোঁয়াচে ভেবে ঘৃণা করে গ্রামের অনেকেই যখন এড়িয়ে যাচ্ছে, হাসান তাকে হাত ধরে তুলে আস্তানায় পৌঁছে দেয়। হাসান চরিত্রে আনোয়ার হোসেন আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন।

পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে পড়ে শিরিন এই পল্লিতে এসে পৌঁছালেও, মনপ্রাণে খুঁজেছে হারানো স্বামী হাসানকে। হাসানের সঙ্গে শিরিনের প্রথম সাক্ষাতের গল্পটাও চমৎকার। নামাজ পড়া শেষে হাসান নিজের খাবার এক অনাহারীকে দিয়ে দেয়। নদীতে মুখ ধুতে গিয়ে ভেসে আসা একটা ফল খুঁজে পায়। সেই ফলে কামড় বসায়। কিছুটা খেয়ে নেয়। কিন্তু হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগে এই ফলের মালিক কে? তাঁর অনুমতি ছাড়া এই ফল খেয়ে সে মস্ত পাপ করেছে। অন্তরের তীব্র পাপবোধ, পাপের গ্লানি নিয়ে হাসান ফল গাছের মালিককে খুঁজতে শুরু করে।

যেন এই বৃক্ষের মালিকই হলেন জগতের ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে ভক্তের অনুসন্ধিৎসু মন। আবার এই ঘটনাটি অন্যভাবে একটি নক্ষত্রের সূত্র ধরে নবজাতক ছোট্ট যিশুকে খুঁজে পেতে তিনজন জ্ঞানী ব্যক্তির সেই যাত্রার কথাটিও কি আমাদের মনে করিয়ে দেয় না? হাসান বৃক্ষের মালিকের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। জগতের এমন ধার্মিক নীতিবান সৎ মানুষকে দেখে শিরিনের বাবার মন গলে যায়। হাসান তাঁর কাছে অনুমতি ছাড়া ফল খাওয়ার জন্য ক্ষমা চান। শিরিনের বাবা বলেন, ক্ষমা করতে পারেন, তবে তাঁদের বাড়িতে হাসানকে থাকতে হবে। বাড়ির কাজ দেখাশোনা করতে হবে। হাসান এই আদেশকে ঈশ্বরের আদেশ বলে মেনে নেয়।

এভাবে কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও শিরিনের বাবা হাসানকে বন্ধনমুক্ত করতে চাননি। জানিয়ে দেন, এই বৃক্ষের আসল মালিক হলো তার কন্যা শিরিন। হাসান যদি শিরিনকে বিয়ে করে তিনি খুশি হবেন। মালিকের কন্যাকে বিয়ে করতে হাসানের মন সায় দেয় না। কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বরের ইচ্ছা সে না করবে কীভাবে! এভাবে হাসান আর শিরিনের রাজযোটক মিলন হয়। শিরিনের কাছে হাসান হলো প্রথম উন্মুক্ত পৃথিবী; খাঁচার পাখিকে ডানা দিয়ে স্বাধীন করে সে প্রথম বিশ্ব দর্শন করিয়েছে। এই কন্যা চোখ থাকতেও ছিল অন্ধ, কথা বলতে পারা সত্ত্বেও এত দিন ছিল বোবা। সেই অন্ধ বোবা প্রতিবন্ধী ঈশ্বরকে মায়াময় পৃথিবীর নতুন আলো দিল অন্য এক হৃদয় ঈশ্বর।

হাসান চরিত্রটি এমনই, অন্যের দুঃখে কেঁদে ওঠে তার মন। পথের ধারে কষ্ট পাওয়া কুষ্ঠরোগীকে ছোঁয়াচে ভেবে ঘৃণা করে গ্রামের অনেকেই যখন এড়িয়ে যাচ্ছে, হাসান তাকে হাত ধরে তুলে আস্তানায় পৌঁছে দেয়। হাসান চরিত্রে আনোয়ার হোসেন আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন। নিজের শ্রেষ্ঠ অংশটুকু দিয়ে এই চলচ্চিত্রে নিজেকে বানিয়ে তুলেছেন অভিনয়–জগতের ঈশ্বর, দয়াল মুরশিদ। দক্ষ অভিনেতা আনোয়ারের সঙ্গে শিরিন চরিত্রে তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয় করেছেন সুচন্দা। এ ছাড়া মেহফুজ, সাত্তার, মুরাদ, আনিস সবাই যথাযথ। সংগীত পরিচালনা করেছেন লোকসংগীতশিল্পী সর্দার আলাউদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেতারে গান করে আলাউদ্দিন গোটা জাতিকে দেশমাতৃকার মুক্তির স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মমতাজ আলী খান, সৈয়দ আব্দুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমিন, মাহাবুবা রহমান, আব্দুর রউফ, খুরশিদ আলম ও আবদুল আলীম। এই চলচ্চিত্রে প্রথম নৃত্য পরিচালনা করেন আমির হোসেন বাবু। শহীদুল ইসলামের সম্পাদনায় নাচে, গানে, অভিনয়ে সুন্দর নান্দনিক একটি চলচ্চিত্র ‘দয়াল মুরশিদ’।

যেন হরিনামে জগৎ মাতাতে এসেছে একলা নিতাই পরিচালক রূপসনাতন। তুমি তাকে ভজনা করছ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। অন্য কেউ বলছে, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। এক পানি; কেউ বলছি জল, কেউ ওয়াটার। ঈশ্বরের পৃথিবীতে স্বর্গ-নরক যে মানুষের মধ্যেই সুরাসুর।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত