হাজার শব্দের কাঠখোট্টা খবরের চেয়ে একটি মানবিক আবেদনপূর্ণ ছবি কিংবা লেখা অনেক তাড়াতাড়ি পাঠকের মনোযোগ কেড়ে নেয়। একটি প্রচলিত কথা আছে, ফিচার হচ্ছে লেবু থেকে লেমনেড বানানো।
সাংবাদিকতায় তখন নতুন, কাজ করি সংবাদ-এ। পিআইবিতে ছিল ফিচারবিষয়ক একটি কর্মশালা। সেখানেই প্রথম শুনেছিলাম একটি কথা, যা আর ভুলিনি।
শিক্ষক বলছিলেন, ‘শুনুন, নিউজ যদি হয় মস্তিষ্ক, তাহলে ফিচার হলো হৃদয়।’
সেই থেকে আমি হৃদয়ের কারবারি। নিউজ বা সংবাদের চেয়ে এই ফিচার লিখতেই ভালো লাগে।
সংবাদ পত্রিকাতেই, ১৯৯৭ সালে, একদিন হন্তদন্ত হয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন সহকারী সম্পাদক সোহরাব হাসান। উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘একটা ফিচার করে দিতে পারেন, ফিচার? চে গুয়েভারাকে নিয়ে?’
সে সময় চে গুয়েভারার মৃত্যুরহস্য উন্মোচিত হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসেছে চে’কে নিয়ে প্রতিবেদন, ফিচার। সেগুলো পড়ে নিজের মতো করে লিখতে হবে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের শেষভাগে এসেও ফিচার শব্দের অর্থ জানতে পারিনি। ফলে যেভাবে বুঝি, সেভাবেই লিখলাম। পরপর তিন দিন সেটা ছাপা হলো সংবাদ-এ। প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকা ভোরের কাগজও নিজেদের মতো করে ছাপল ফিচার। তুলনামূলক বিচারে বুঝতে পারলাম, ফিচার জিনিসটা কী, আর এ-ও বুঝলাম, আমি আসলে ফিচারটা ভালোই লিখতে পারব।
কাকে বলে ফিচার?
সংজ্ঞা-টংজ্ঞা দিলেই এই লেখা পড়ার আগ্রহ কারও থাকবে না। তাই সরাসরি বলি, কঠিন খবরের পাশাপাশি যে কোমল খবরগুলো ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়, সেগুলোই ফিচার। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, মানবিক কাহিনিগুলো মানুষের মন ছুয়ে যায় দ্রুত। হাজার শব্দের কাঠখোট্টা খবরের চেয়ে একটি মানবিক আবেদনপূর্ণ ছবি কিংবা লেখা অনেক তাড়াতাড়ি পাঠকের মনোযোগ কেড়ে নেয়। একটি প্রচলিত কথা আছে, ফিচার হচ্ছে লেবু থেকে লেমনেড বানানো। মানুষের হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক।
বেশি কথা না বলে কাছাকাছি সময় থেকে একটি উদাহরণ দিই। এই তো কয়েক বছর আগে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির কথা নিশ্চয় আপনারা কেউ ভুলে যাননি। সে সময় কয়েক দিন ধরেই পত্রিকা আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিশাল জায়গা ও সময়জুড়ে ছিল এই ট্র্যাজেডির খবর। একটু লক্ষ করুন, কোন খবরগুলো আপনাদের মন কেড়েছে? সেখানে ছিল উদ্ধার তৎপরতার খবর, মন্ত্রীদের বাণী ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আপনাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল কোন খবরগুলো, মনে পড়ে? এনাম মেডিকেল কলেজে উদ্ধার-পরবর্তী সেবা, কেউ বেঁচে বেরিয়েছেন, তাঁর সাক্ষাৎকার, কেউ বহু দূর থেকে এসেছেন ছেলে বা মেয়ের খোঁজে, হাতে তার সন্তানের ছবি—এগুলোই কি বেশি নজর কাড়েনি? যদি কেড়ে থাকে, তাহলে কেন? কারণ আর কিছু নয়, এগুলোতে হৃদয়ের ছোঁয়া রয়েছে। নিরেট খবরের চেয়ে এ কারণেই এগুলোর প্রতি আপনার মনোযোগ বেশি।
আবার অন্য একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, ঢাকা থেকে বরযাত্রী যাচ্ছে ফরিদপুরে। হিন্দু পরিবার। দুই মাইক্রোবাসভর্তি মানুষ। বউয়ের বাড়িতে সে কী তোড়জোড়। রান্না চড়েছে চুলোয়। কিন্তু বিকেলের দিকে খবর এল দুর্ঘটনায় পড়েছে মাইক্রোবাস। হবু বর নিহত। ভেবে দেখুন তো অবস্থাটা! বরের জায়গায় লাশ এল। যে কাঠ দিয়ে হওয়ার কথা ছিল রান্না, সেই কাঠ দিয়েই জ্বালানো হলো চিতা। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? এই কথাগুলো খবর হিসেবে লিখলে তো দিতে হবে নিরেট কথাগুলো: ঢাকা থেকে বরযাত্রীসমেত মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পতিত। বরসহ দুজন নিহত। ব্যস! কিন্তু যখন আমরা এই বিষয় নিয়ে ফিচার লিখব, তখন নিরেট খবর থেকে বেরিয়ে কত দিকে হতে পারে আমাদের বিচরণ! আমরা ওই মেয়েটাকে নিয়ে ফিচার করতে পারি, যার চোখে জেগে উঠেছিল রঙিন স্বপ্ন এবং যে স্বপ্ন মুহূর্তে পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে, ফিচার করতে পারি বরের বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে কথা বলে: কেমন ছিল ছেলেটি, কীভাবে বিয়ের কথাবার্তা হলো ইত্যাদি নিয়ে। ফিচার হতে পারে যে কাঠওয়ালা এনে দিয়েছিল বিয়েবাড়ির রান্নার কাঠ, কিন্তু যা ব্যবহৃত হলো চিতার কাঠ হিসেবে, সেই লোকের সঙ্গে। এভাবে ফোকাস ঠিক করা যায় অনেক। যেকোনো ফোকাসই লুফে নেবে পাঠক।
আচ্ছা, আরও কাছাকাছি সময় নিয়ে কথা হোক। এই তো সেদিন ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে কি নাকানিচুবানিই না খাওয়াল বাংলাদেশ! এই পুরো সময়টাতে একটি নাম কিন্তু মন কেড়েছে আমাদের—মুস্তাফিজুর। ওকে নিয়েই তো লেখালেখি হলো অনেক, টিভিতে অনেকটা সময়জুড়ে দেখানো হলো ওর ছবি। এখন মুস্তাফিজুরের প্রথম সাফল্যের পর কোন খবরগুলো আপনার মন টেনে নিয়েছিল, একটু খেয়াল করে দেখুন তো! ঠিক! খেলার খবর তো পড়েছেনই, কিন্তু আপনার জানতে ইচ্ছা করছিল কেমন পরিবার থেকে এসেছে ছেলেটা, ওর সাফল্যে কেমন খুশি বাবা-মা। কে ছিল মুস্তাফিজুরের অনুপ্রেরণা। ওর কোন ভাই ওকে ক্রিকেটার বানানোর জন্য নিজের আয়েশ বিসর্জন দিয়েছে? কোন কোচের কাছে প্রথম পাঠ নিয়েছে ছেলেটা? এগুলো নিয়ে আলাদা কিংবা ছোট করে সব বিষয় ঢুকিয়ে ফিচার করলে তা হয় ওঠে মনগ্রাহী।
ফিচার সুখপাঠ্য হতে হবে। হাসি- কান্না, দুঃখ-বেদনা, আবেগ এমনভাবে তুলে ধরতে হবে, যেন পাঠককে তার চিন্তাশক্তির পাশাপাশি হৃদয়কেও নাড়া দেয়। আর হ্যাঁ, কড়া সংবাদে তাৎক্ষণিকতা একটি বিশাল বিষয়। ফিচারে সেটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অতীতের কথাও আপনি বলতে পারেন ফিচারে, তবে এই সময়টার একটু পরশ বুলিয়ে দিতে পারলেই দেখবেন, মানুষ তা গোগ্রাসে গিলছে।
কীভাবে লিখব
ফিচারের সঙ্গে ছোট গল্পের বেশ মিল আছে। ছোট ছোট বাক্যে, আবার কখনো তারই মাঝে একটি বড় বাক্য লিখে পাঠক আকর্ষণ করা যেতে পারে। ছোটগল্পের সঙ্গে ফিচারের একটাই পার্থক্য, গল্প লেখা হয় খানিকটা অভিজ্ঞতা আর বাকিটা বানিয়ে। কিন্তু ফিচারের সব তথ্য হতে হবে সত্য। আর হ্যাঁ, শুরুতে না হোক, কোনো না কোনোভাবে ‘কে, কী, কেন, কখন, কীভাবে, কোথায়’—এই ছয়টি বিষয় খবরের মতোই ফিচারেও থাকতে হবে। ফিচারের নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নেই, কিন্তু মোটামুটি আমরা বলতে পারি, সূচনা, মাঝের অংশ বা বিস্তার এবং শেষ—এই তিন ভাগে আমরা ভাগ করতে পারি ফিচারকে। ফিচারের আকারও বিষয়ভেদে ছোট- বড় হতে পারে। তবে সাধারণ ফিচার ৩০০ থেকে ৬০০ শব্দের মধ্যে হলে পাঠক আগ্রহ ধরে রাখতে পারে। এর বেশি হলে মনোযোগ রাখা একটু কঠিন হয়ে পড়ে।
সূচনা হতে পারে নানা রকম। আমরা মুস্তাফিজুরের কথা দিয়েই এই অংশটা গড়ে তুলব। তাতে বোঝার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।
ফিচারটা শুরু হতে পারে রহস্য সৃষ্টি করে। যেমন, ওর ভাবনাতেও ছয় উইকেট ছিল না। যখন সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার পথে রওনা হয়, তখনো ওর বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। পারবে তো? একটি উইকেট নিতে পারবে তো? খেলার আগের দিন সারা রাত ঘুমের মধ্যে ছটফট করেছে ছেলেটা।
শুরু হতে পারে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে, যেমন। বলটি ছুটে গেল ওঠার আগেই দেখতে পেল, বোলার গোলার মতো। ব্যাটসম্যান কিছু বুঝে ছেলেটা শিশুদের মতো হাততালি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। আউট! বিরাট কোহলি আউট!
স্মৃতিচারণা দিয়েও শুরু হতে পারে। ‘সাতক্ষীরায় এক ম্যাচে বল করে ছয় উইকেট পেয়েছিলাম। এবার যখন পাঁচ উইকেট পেয়ে গেছি, তখন সে কথাই মনে হতে লাগল,’ বলছিলেন মুস্তাফিজুর। যে ম্যাচে তিনি মন জয় করে নিলেন প্রতিটি মানুষের, সেই ম্যাচে শেষ উইকেট পাওয়ার আগের মুহূর্তের অনুভূতির কথা এভাবেই জানাচ্ছিলেন তিনি। অন্য কারও কথা দিয়েও শুরু হতে পারে। বলটি ভেঙে দিল উইকেট আর গ্যালারিতে সুদর্শন যুবকটি চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বলল, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারত খেলার বদলা নেব এবার! মাঠে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে উৎসব। খেলার এ অবস্থা থেকে শুধু অলৌকিক কোনো ঘটনাই বাংলাদেশের জয় ছিনিয়ে নিতে পারে। শুরুতে থাকতে পারে প্রশ্ন: মুস্তাফিজ কি আর একটি উইকেট পাবে? প্রশ্নটি দর্শকদের মনে ঘুরছে অবিরত।
বৈপরীত্য থেকেও শুরু হতে পারে, মাশরাফি একটি উইকেটও পাননি তখন পর্যন্ত। এরই মধ্যে মুস্তাফিজুরের ঝুলিতে চার-চারটি উইকেট। অধিনায়কের কিন্তু তাতে পরোয়া নেই। মুস্তাফিজুরের কাছে এসে তিনি বলে যাচ্ছেন, কী করে নিশানা ঠিক রেখে বল করে যেতে হবে। অধিনায়ক এবার বাংলাদেশকে বিজয়ী দল হিসেবে দেখতে চাইছেন।
যে সূচনার কথা বললাম, সেটাই কিন্তু ফিচার-গাড়ির ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিনের দায়িত্ব হচ্ছে পুরো ফিচারটিকে টেনে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। এই বিস্তারই কিন্তু আপনাকে পৌঁছে দেবে ঠিক গন্তব্যে। এখানেই মূল রচনাটিকে রসিয়ে বর্ণনা করার সুযোগ মিলবে। মনে রাখবেন, যান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে পড়ে গেলেই সর্বনাশ। প্রতিটি ফিচারকেই হতে হবে নতুন কিছু। ফিচারের শেষটাও হতে হবে আকর্ষণীয়। বিস্তার অংশে যে কথাগুলো বলা হলো, তারই রেশ যেন রয়ে যায় পাঠকের মনে। পড়া শেষ করেও পাঠক যেন ফিচারটি নিয়ে ভাবেন। কখনো কখনো সূচনার কথাগুলোই একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা যায় শেষে, সেটা বেশ তৃপ্তি দেয় পাঠকের মনে। ছোট গল্পের মতোই এটা ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ ধরনের স্পর্শ দিতে পারে মনে।
হ্যাঁ, ফিচারে মানুষের হাসি-কান্না- আবেগ-শোক-ভয়—সবকিছুই প্রকাশ পায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেটা যেন শেষ পর্যন্ত মেলোড্রামায় পরিণত না হয়। জোলো আবেগ ফিচারের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। আর ভালো ফিচার লেখার জন্য ভালো সাহিত্য ও ফিচার বেশি বেশি পড়ার কোনো বিকল্প নেই। ফিচার গাইড পড়ে ভালো ফিচার লেখক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, শঙ্খ ঘোষ, সৈয়দ শামসুল হকের লেখা থেকে বাক্যের চলন লিখে নেওয়া যেতে পারে। তেমনি অনেক লেখকের লেখাই ফিচারের জন্য আদর্শ হয়ে উঠতে পারে, যাঁদের নাম হয়তো আমার জানা নেই। মাসুদ রানা পড়লেও ভাষার একটি অসাধারণ চলনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়।
আর খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, রবীন্দ্রনাথের ভাষা কত সরল আর রসাল। এখানে পেয়ে যাবেন যাবতীয় লেখার স্বর্ণখনি। কিন্তু কীভাবে তা আপনার লেখায় ব্যবহার করবেন, সেটা আপনার বিষয়।
কী নিয়ে ফিচার?
যেকোনো বিষয় নিয়েই ফিচার লেখা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক নানা ঘটনা, লাইফস্টাইল, ঐতিহাসিক ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষাব্যবস্থা, সীমান্ত এলাকা, ফসলের খেত, লঞ্চভ্রমণ, স্টেডিয়াম, ঈদের ছুটিতে মানুষের বাড়িযাত্রা—এভাবে বলে শেষ করা যাবে না। তাৎক্ষণিকতার দায় নেই বলে যা ইচ্ছা তা-ই কিন্তু লেখা যাবে না। যেকোনোভাবে হোক সময়ের সঙ্গে একটা সংযোগও তৈরি করতে হবে লেখায়।
লেখার জন্য চাই বিষয়টি বোঝার ক্ষমতা, গবেষণা এবং কী বলতে চাইছি, তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। তারপর স্বাদু গদ্যে লিখে ফেললেই তা মন কাড়বে পাঠকের।
তাহলে আর কী! এখনই যেকোনো একটি বিষয় নিয়ে লিখতে বসে যান!
লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।