গোমড়ামুখো হয়ে আছে আকাশ। এখনো পুরোপুরি মেঘের ঘোর কাটেনি। থেমে থেমে দমকা হওয়া বইছে। বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুলছে নিমগাছের প্রস্ফুটিত ডালগুলো। পরস্পরের গায়ে দুলে পড়ছে; আবার ফিরে আসছে নিজের জায়গায়। দক্ষিণ দিকের বরই গাছটার একটা ডাল ভেঙে পড়েছে কলাগাছের ওপর। চোখ বড় বড় করে গাছটির দিকে তাকিয়ে আছে হাশেম। না কিচ্ছুটি হয়নি। শালিক পাখির বাসাটা একরকম অক্ষতই আছে বলা যায়। কোনো ভাঙনের চিহ্নের লেশমাত্র নেই।
ধীরে ধীরে চারপাশ আরও বেশি পরিষ্কার হয়ে আসছে। সূর্য উঠবে বোধহয়। আজকে তাহলে কদিন পর সূর্য উঠতে চলছে? চার-পাঁচ দিন তো হবেই। বাগানের ওই দিক দিয়ে পানি যাচ্ছে বিলের দিকে। পানি নামার একধরনের মনোমুগ্ধকর কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন এক মোহনীয় সুরে বয়ে চলেছে। নীরবতা ভেঙে ক্রমাগত আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে মনে হয়। যা হোক, খুব একটা খারাপ লাগছে না।
নিথর হয়ে পড়ে আছে হাশেম। এভাবে আর কতক্ষণ অসাড় হয়ে পড়ে থাকবে কে জানে! উঠতে ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ কয়েকটি কাক কা কা করে এদিক থেকে ওদিক উড়ে যায়। আপাতত তাদের ডাক গগনবিদারী বলেই মনে হলো। খাঁ বাড়ির স্কুলের ধারে এখনই অনেক মানুষ জমা হয়ে গেছে মনে হয়। হওয়ারই কথা। এ রকম প্রলয়ংকরী ঝড় বন্যার পর না এসে পারে না।
নিশ্চয়ই বহু সংগঠনও এসেছে ত্রাণ নিয়ে। প্রতিবছরই তো আসে। দল বেঁধে আসে। সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়ার পর তারা ঠিকই এসে দাঁড়ায় অসহায় মানুষদের পাশে। কিন্তু কী হয় সব ত্রাণের টাকা দিয়ে একটা মজবুত বাঁধ নির্মাণ করলে। প্রতিবছরই তো কত কত ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। কারও কি একটুও সংবিৎ ফিরছে না? হঠাৎ তার সমস্ত ইন্দ্রিয় চমকে ওঠে। সেই ডাকটা আবারও শুনতে পায় হাশেম—‘বাবা! বাবা! এই তো আমি, পানিতে ডুবে যাচ্ছি। বাঁচাও বাবা, বাঁচাও। আমি আর একটুও দুষ্টুমি করব না বাবা।’
কিন্তু কোথাও তো পানি নেই। স্রোতের তীব্রতায় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সব। কত স্বপ্ন, ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকুও নিয়ে গেছে সঙ্গে করে। এত এত পানির সঙ্গে হয়তো আবুল হাশেমের চোখের পানিও চলে গেছে। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে ভীষণ বেদনায়। তার ছোট মেয়েটি হয়তো এখন আর বেঁচে নেই। তবু তার ডাক বারবার ভেসে আসছে প্রবল বেগে কর্ণকুহরে। সমগ্র পৃথিবী যেন ভরে গেছে অসীম শূন্যতায়। হু হু করে কেঁদে ওঠে এক অসহায় বাবা।