‘কষ্টনীড়’-এর আঙিনায় বৃহত্তর সমাজ-রাষ্ট্রদর্শন

‘কষ্টনীড়’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যসংগৃহীত
তারিক আনাম খান, শ্যামল মওলা, সায়েদ বাবু, ইয়াশ রোহান, সাবিলা নূর, রুনা খান—সবার অভিনয়ে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে পট, প্রেক্ষাপট, দৃশ্যপট।

আশফাক নিপুন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতের এখন আলোকোজ্জ্বল একটি নাম। মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, কৌতূহলোদ্দীপক সুনিপুণ চলচ্চিত্র নির্মাণে চট্টলার এই তরুণ সন্তানের জুড়ি মেলা ভার। বর্তমান সময়, সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা চলচ্চিত্রে তর্কবিতর্কের মতো ডালপালা মেলে। কিন্তু সেই কঠিন ভাবনা কোথাও আবার এতটুকু রাশভারী হয়ে ওঠে না। দর্শককে গভীর চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন করে আবার চৌকস নির্মাণের আঙিনায় বিপুল আনন্দ দেয়।

বর্তমান সমাজের ছায়াজড়িত শৈল্পিক দর্পণে উঠে আসা ‘কষ্টনীড়’ নামের ছবিটিতে আমরা দেখলাম, একটি অবস্থাপন্ন পরিবারের পিতা ও ছেলেমেয়েদের মাধ্যমে কীভাবে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাটাকে সবার সামনে তুলে আনা হলো। বাবা শামসুল হক চৌধুরী একজন ধনী শিল্পপতি, সমাজের প্রভাবশালী বিত্তবান মানুষ। এখানে একনায়কতন্ত্রের প্রতীক। নিজের ইচ্ছেমতো ছেলেমেয়েদের চালানোর চেষ্টা করে সে। কারও কোনো মতের প্রাধান্য দেয় না।

বড় মেয়ে রিজওয়ানাকে অতি অল্প বয়সে অন্য এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে দেয় শামসুল হক। রিজওয়ানার স্বামী এত ব্যস্ত যে দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবনে সন্তানসন্ততি নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। বাবা ও স্বামী—দুজনের দাপটের কাছে নিজের সব সুচিন্তিত মতামত জলাঞ্জলি দিতে দিতে এই কন্যার জীবনে এখন স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। নিজের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কাছে হার মানতে মানতে এখন যেন সবকিছুকে চাপা দিয়ে নিজেকে সুখী বলে তুলে ধরতে চায় সে। একটু বেশি কথা বলে, পেটে কোনো কথা চাপা থাকে না, কোথায় কোন পরিস্থিতিতে কোন কথা বলতে হবে, বুঝে উঠতে পারে না। অনেকের কাছে সে যেন বোধবুদ্ধিহীন জোকার। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি—সমাজে নারীর অবস্থানের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র এই রিজওয়ানা।

তবে রিজওয়ানার তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন, সুশিক্ষিত, আধুনিক, এই সময়ের অন্য এক চরিত্র শামসুল হকের আরেক কন্যা রাশনা। সে পুরোনো কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় প্রাণ খুলে আড্ডা দিতে পারে। দাদা রায়হানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দিতে পারে। বাবার পুঁজির ধার না ধেরে নিজের প্রচেষ্টায় স্বাধীন কর্ম উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। যদিও বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে। রাশনা মন থেকে বিয়ে করতে চায় না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। বাবার দাপটের কাছে তাকেও মাথা নুইয়ে চলতে হয়।

বড় ছেলে রিজওয়ান বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। নিজের সমস্ত ব্যক্তিত্ব, মতামত আপস করে চলতে চলতে বাবাকে শিরোধার্য করে নিয়েছে। সে পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাসী। এই পরিবারতন্ত্র সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি—সবকিছুকে আজ ধ্বংস করে চলেছে বলে মনে করে পরিবারের আরেক সন্তান রায়হান। সে দাদা রিজওয়ানকে আহমদ ছফার উক্তি শোনায়, ‘শুকোরের বাচ্চা প্রথম যখন বড় হয়, তার প্রথম কাজটা হচ্ছে বাপের পাছায় কামড় দেওয়া…।’

মূলত এই রায়হান হচ্ছে শিল্পপতি বাবার একেবারে উল্টো পিঠের—বখাটে, বাউন্ডুলে ছেলে। সে সমাজবদলের সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী। সে মনে করে, টাঙ্গাইল হাইস্কুলের একজন সাধারণ শিক্ষকের ছেলে হয়েও তার বাবা অনেকের রক্ত-মাংস শুষে পুঁজির পাহাড় তৈরি করে আজ এ জায়গায় এসে পৌঁছেছে। বাবাকে ভয় পাওয়া দূরে থাক, বাবার আক্রমণের মুখে সে কড়া জবাব দেয়। বড় ভাই তাকে বলে, আজ যদি তুই কোনো বিপ্লবী কাজে ফেঁসে যাস, তোর মার্ক্স, লেনিন কিন্তু তোকে বাঁচাতে আসবে না। এই পরিবার, এই বাবাকে তখন প্রয়োজন হবে।

পুঁজিপতি বাবার সমাজতান্ত্রিক ছেলেকে তো দেখলাম। বাবার মনগড়া একই পরিবারের একেবারে ভিন্ন মনস্ক অন্য একটি ছেলে হলো রিদওয়ান। সে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। ঈশ্বরে বিশ্বাসী, ধর্ম-অন্তঃপ্রাণ। বাবা তাকে ইসলামিক উচ্চশিক্ষার জন্য পৃথিবীর বিখ্যাত কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পাঠাতে চায়। রায়হান মনে করে, তাদের পুঁজিপতি বাবা নিজের কালো পুঁজিকে সাদা করার জন্য আসলে এই ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়িয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাও ঠিক এভাবে ধর্মকে পুঁজি করে মানুষকে আফিম দিয়ে বুঁদ করে রাখে, আর নিজের সমস্ত অপকর্ম চালিয়ে যায়, ক্ষমতা ধরে রাখে।

দিদি রাশনার বিয়েতে নাচ, গান হবে—এসব অনুষ্ঠানেও রিদওয়ানের বিশ্বাস নেই। সে এসব বাঙালি আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না। অন্য একজন জঙ্গি নেতা আজ আবার তার মাথায় ঢুকিয়েছে, শুধু ভোগবাদী আমেরিকান অথবা সমাজতান্ত্রিক মানুষেরা নয়, যারা আজ ইসলামি জঙ্গি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাস করে না, সবাই ইসলাম ধর্মের শত্রু। এই অবিশ্বাসী সব শত্রুদের বিনাশ করে ধর্মকে উদ্ধার করতে হবে।

এভাবে রিদওয়ানও জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পড়তে যাচ্ছিল; তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে এসব কাজ না করলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে। দাদা রায়হান চাপা স্বভাবের ভাইয়ের মুখ থেকে একসময় সব কথা জেনে যায়। নির্ভীক, সাহসী, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার কান্ডারি, সমাজতন্ত্রের মতাদর্শে বিশ্বাসী এই দাদা ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সেই জঙ্গি নেতার ডেরায় ছুটে যায়, আর বেদম ধোলাই দিয়ে আসে।

রাষ্ট্রবিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য রায়হানকেও আবার পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। শিল্পপতি বাবা কিছুতেই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে চায় না। রাশনা, বাবার ইগোর মুখে রুখে দাঁড়ায়। ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের কোনো ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দেওয়ার প্রতিবাদ জানায়। বাবা একসময় নিজের ভুল বুঝতে পারে। বিপ্লবী ছেলেকে ছাড়িয়ে আনে। রাশনাকেও এখন আর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিতে চায় না। কষ্টনীড় নষ্ট নীড় হওয়া থেকে রক্ষা পায়। ধীরে ধীরে সুখের নীড় হয়ে ওঠে।

আশফাক নিপুনও এমনই একটা সুখী সুন্দর রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন বুনে দিয়ে এই ছায়াছবি নির্মাণ করেছেন। ঝকঝকে দৃশ্য বুননে, টান টান বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ, চিত্রনাট্যের এই ছবি চমৎকার। বড় বড় ভাবনা মাথায় না নিয়েও অতি সাধারণ দর্শকের মনোরঞ্জনের খোরাক জোগাবে। আবার পারিবারিক ছবি লেবেল লাগিয়ে ছোট করারও উপায় নেই। তারিক আনাম খান, শ্যামল মওলা, সায়েদ বাবু, ইয়াশ রোহান, সাবিলা নূর, রুনা খান—সবার অভিনয়ে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে পট, প্রেক্ষাপট, দৃশ্যপট। সাবিলাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বিপ্লবীর চরিত্রে অভিনয় করতে করতে শ্যামল মওলা মানুষের মনে সমাজতান্ত্রিক নেতা হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন।

‘কষ্টনীড়’ যে আসলে একটি সুন্দর, সামাজিক পটচ্ছবি। শুরুতে শ্যামল লাল কালিতে দেয়াল লিখছিল—‘একটাই যুক্তি, শোষণ থেকে মুক্তি/ একটাই মন্ত্র, সমাজতন্ত্র’। ঠিক তখন তার কাছে একটা ফোন আসে নিজেকে আড়াল করে নেওয়ার জন্য। এই দৃশ্য দুই বাংলার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মকাণ্ডকে মনে করিয়ে দেয়। একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় সমাজবদলের বিপ্লবের হাতিয়ার পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমাগুলোকেও। সেই সব সিনেমার ভিতের ওপর একেবারে নতুন আঙ্গিকে, নতুন দর্শনে এ এক নতুন সিনেমা। বানিয়েছেন সূর্য সেনের মাটির চট্টলার সন্তান আশফাক নিপুন।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত