মানবিক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক

অলংকরণ: তুলি

২০১৩ সালে অফিশিয়াল কাজে পাবনা শহরে গিয়েছিলাম। সুহৃদ কাজী সোহেল ও আবুল মনজুর পাবনার হেমায়েতপুরের মানসিক হাসপাতাল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। কোনো এক সময় মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য নাকি ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচিতে যেতে হতো। পাকিস্তান ও ভারত আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পর, ১৯৫৭ সালে পাবনা শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে হেমায়েতপুরের জমিদার বাড়িতে এই মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তৎকালীন পাবনার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী। ভূমিদাতা ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র। ব্রিটিশ আমলে করা মানসিক হাসপাতালটি হওয়ার কথা ছিল ভারতে।

সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছিল। হাসপাতালে প্রবেশ করতে বিচিত্র আওয়াজ শুনে ভয়ে গা ছমছম করছিল। বিভিন্ন কক্ষ থেকে ভেসে আসছে গলা ফাটানো চিৎকার, খিলখিল হাসি, কেউ পশুপাখির ডাক দিচ্ছে, কান্নার আওয়াজ, চেঁচামেচি নানা বিচিত্র শব্দ। কত সুদর্শন তরুণ, যুবতী, নানা বয়সের মানসিক রোগীদের দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কক্ষগুলো জেলখানার মতো বাইর থেকে তালাবদ্ধ। কিছু আছে হাসপাতালের বেডের মতো। অনেক রোগীকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। একটা কক্ষের সামনে গিয়ে অবাক হলাম, এক মেধাবী তরুণ নির্ভুলভাবে রবার্ট ফরেস্টের কবিতা আবৃত্তি করছে। কত সুন্দর উচ্চারণ, কবিতার চরণগুলো এখনো কানে বাজে— ‘A Minor Bird-I have wished a bird would fly away, and not sing by my house all day Have clapped my hands at him from the door when it seemed as if I could bear no more…।’

অন্য একজন নাটোরের ‘বনলতা সেন’ গলা ফাটিয়ে পড়ছে। চিৎকার করে বলছে, ‘আমার বনলতা আমার মোনালিসা, আমার সোনার ময়না পাখি, আমার জীবন তুমি কোথায় জানো পাখি, আমি হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় থাকব জান!’ এক যুবতীকে দেখলাম গান করছে, ‘পর মানুষে দুঃখ দিলে দুঃখ মনে হয় না। আপন মানুষ কষ্ট দিলে মেনে নেওয়া যায় না।’ বুঝতে বাকি রইল না এরা অনেকে ব্যর্থ প্রেমিক; কেউ বংশগত, কেউবা দুর্ঘটনার শিকার।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার এক ভাইকে পেয়েছিলাম। তিনিও মানসিক রোগী হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন। আমরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলাম যে তিনি শুনে ফেলেন। জানালার ফটক দিয়ে হাত জোড় করে বিনয়ের সহিত বললেন, ‘বদ্দা আঁর বাড়ি চাটগাঁ শহরত।’ জানালেন, তাঁর ভাই তাঁকে হাসপাতালে রেখে গেছেন সাত বছর হলো। কেউ দেখতে আসেন না। এখন সুস্থ; কিন্তু পাগলা গারদে ভালো নেই, অনেক কষ্টে আছেন। ভাইয়ের মুঠোফোন নম্বর ও ঠিকানা দিলেন। তিনি বলেন, প্লিজ চট্টগ্রামে গেলে, আমার ভাইকে বলবেন আমাকে নিয়ে যেতে। কতদিন বাবা-মায়ের মুখ দেখি না। কয়েদির মতো জেলখানায় পড়ে আছি। মা–বাপর লাই পেট ফুরেদ্দে বদ্দা! বলে কেঁদে দিল।

পাবনার হেমায়েতপুরের মানসিক হাসপাতাল প্রাঙ্গণে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমিও আবেগ আপ্লুত হলাম, চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ল। তাকে বললাম, ‘কথা দিচ্ছি, আমি চট্টগ্রামে গিয়ে আপনার ভাইকে খুঁজে বের করব, আপনার বার্তাটি দিব।’ আমি তাঁর কথা রেখেছিলাম। জানিনা সে এখন কেমন আছে। মানসিক হাসপাতাল থেকে যখন বের হচ্ছিলাম তখন বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যাই মানসিক রোগীদের জীবন দেখে।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় এতিম তোফাজ্জলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারার দৃশ্য। যা দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া পড়ে। সহকর্মী জামাল ভাইয়ের পাশের গ্রামে তোফাজ্জলের বাড়ি। অনার্স পাস। মেধাবী এই যুবকের বাবা মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। কিছুদিন পরে মা–ও মারা যান ক্যানসারে। একমাত্র ভাই নাসির হোসেনও ক্যানসারে মারা যান। এক মেয়েকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন, সেই প্রেমও টেকেনি। তোফাজ্জল তাঁর প্রিয়জন ও কাছের মানুষদের হারিয়ে মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে তিনি অনাহারে পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের কাছ থেকে খাবার খুঁজে খেতেন, টাকাপয়সা চাইতেন। কখনো চুরি করতেন না। অনেক সময় তাঁর পরিধানের কাপড় পর্যন্ত থাকত না। তোফাজ্জল একসময় রাজধানীতে চলে আসেন।

আহা জীবন! চোর সন্দেহে তাঁকে এক মুঠো ডাল-ভাত–সবজি খাইয়ে একদল উন্মত্ত দানব পিটিয়ে মেরেছে। দৃশ্যটা দেখে বুক ভেঙেছে, নীরবে কেঁদেছি। অথচ পোষা প্রাণীকেও কেউ এভাবে মারে না। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে রাস্তার বেওয়ারিশ পোষা কুকুর, বিড়ালকে দেখি কিছু মানবিক মানুষ খাবার খেতে দেয়, যত্ন করে, অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাও করায়। অনেকের কাছে পোষা প্রাণী পরিবারের বাকি সদস্যদের মতো আপন।

ট্র্যাজেডিতে ভরা তোফাজ্জলের জীবন দেখে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানুষ বড় সস্তা’ কবিতাটির চরণ মনে পড়ল— ‘ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে,/ মানুষ ছিল নরম, কেটে ছড়িয়ে দিলে পারত।/ পথের হদিস পথই জানে, মনের কথা মত্ত,/ মানুষ বড় শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারত।’
কবিতায় ছেলেটা খুব ভুল করেছে পাথর ভেঙে; কিন্তু এতিম তোফাজ্জল কোনো ভুল করেনি।

বর্তমান সময়ে সন্দেহ একটা ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নষ্ট রাজনীতির কিছু বিকৃতমনা উন্মত্ত বিচারের নামে সংঘাত-সহিংসতা লিপ্ত হয়ে পশুপাখির মতো পিটিয়ে হত্যা করছে। জানি না বিশ্বে মানসিক রোগীকে পিটিয়ে মারার এমন নজির আর কোথাও আছে কি না। মানুষকে ফানুস হতেও দেখলাম। মানুষের মায়া-মমতা, ভালোবাসার বন্ধন, আদর-স্নেহ একে অপরকে সম্মান করা, সম্প্রীতি সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বিলীনের পথে। মানুষ কি আজ সত্যি রঙিন ফানুসে পরিণত হলো? জীবনে খারাপ সময় এলে ভালো মানুষও চেনা যায়, আবার খারাপ মানুষও চেনা যায়। কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘একটা মানুষের মধ্যেই গোঁজামিল থাকে। কিন্তু যে সাপ সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাপ। যে শিয়াল সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়াল। মানুষ সাপও হইতে পারে, শিয়ালও হইতে পারে, পাখিও হইতে পারে। মানুষেরই বিভিন্ন চরিত্র নেওয়ার ক্ষমতা আছে। গ্রাম দেশে আগে সাপ আর শিয়াল পাওয়া যাইত, এগুলো নাই এখন। কারণ সাপ, শিয়াল এরা মানুষ হিসেবে জন্মাইতে আরম্ভ করেছে।’

ভূপেন হাজারিকার ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ গানের কথা মনে পড়ছে। আসুন আমরা মানবিক মানুষ হই। নতুন ভোর আসবে। সংঘাত-সহিংসতা নয়, সবাইকে নিয়ে গড়ে উঠুক আগামীর বাংলাদেশ।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা