গ্রীষ্মের তপ্ত গরম, কনকনে শীত কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে’ গানের মতো বৃষ্টির দিন—যা–ই হোক না কেন, সিলেটের ঐতিহাসিক কিন ব্রিজ তার রূপ ও মাধুর্য দিয়ে সব সময় বিমোহিত করে। পর্যটন নগরী সিলেটে দেখার মতো অসংখ্য মনোমুগ্ধকর দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেকোনো পর্যটকের জন্য সিলেট হতে পারে চমৎকার গন্তব্য। দর্শনীয় স্থানের কথা বলতে গিয়ে সবাই সিলেটের ঐতিহ্য কিন ব্রিজের কথা ভুলে যান। এই ব্রিজ সিলেট শহরের প্রবেশদ্বার। প্রতিদিন এখানে হাজারো মানুষের আনাগোনা দেখা যায়।
গত শতকের তিরিশের দশকের দিকে আসাম প্রদেশের গভর্নর ছিলেন মাইকেল কিন। তিনি সিলেট সফরে আসেন। তাঁর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতেই এই ব্রিজ নির্মাণ ও নামকরণ করা হয় গভর্নর মাইকেল কিনের নামানুসারে। তিনি ১৯৩২ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত আসামের গভর্নর ছিলেন।
এখন ব্রিজ দিয়ে শুধু পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়, অন্য কোনো যানবাহন চলে না।
আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল কিন সিলেট সফরে আসার জন্য সুরমা নদীতে ব্রিজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন আসামের সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। তাই রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। কিন ব্রিজ লোহা দিয়ে তৈরি। আকৃতি ধনুকের ছিলার মতো বাঁকানো। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ১৫০ ফুট এবং প্রস্থ ১৮ ফুট। নির্মাণে তৎকালীন সময়ে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। আবদুল মজিদ কাপ্তান মিয়া, তৎকালীন আসাম সরকারের এক্সিকিউটিভ সদস্য রায় বাহাদুর প্রমোদ চন্দ্র দত্ত ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ ব্রিজটি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে কিন ব্রিজের উত্তর পাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়; যা স্বাধীনতার পর কাঠ ও বেইলি পার্টস দিয়ে মেরামত করে হালকা যান চলাচলের উপযোগী করা হয়। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতায় ব্রিজের বিধ্বস্ত অংশটি কংক্রিট দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং তৎকালীন নৌবাহিনীর প্রধান রিয়াল অ্যাডমিরাল এম এইচ খান সংস্কার করা ব্রিজটি উদ্বোধন করেন। ফলে এটি দিয়ে যান চলাচল আবার শুরু হয়।
ব্রিজটির পাশেই রয়েছে বিখ্যাত আলি আমজাদের ঘড়ি। ঘড়িটিকে অনেকেই লন্ডনের বিখ্যাত বিগ বেনের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। বিশাল ঘড়িটি ইতিহাসের অনেক বিষয়ের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
ব্রিজটি বর্তমানে সব যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত নয়। ২০২৩ সালে কিন ব্রিজ আবার সংস্কার করা হয়। এখন ব্রিজ দিয়ে শুধু পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়, অন্য কোনো যানবাহন চলে না।
গোধূলিবেলায় ব্রিজে দাঁড়িয়ে সুরমা নদীর বুকে সূর্য ডোবার দৃশ্য যতবার দেখি, ততবারই বিমোহিত হই। শীতের সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন ব্রিজের রূপও চোখ কেড়ে নেওয়ার মতো। সন্ধ্যার পরে ব্রিজের নিচে দেখা যায় হরেক রকম মানুষের আনাগোনা। কেউ কেউ গিটার, উকুলেলে, দোতারা, খমকমিশ্রিত বিভিন্ন লোকসংগীতের আড্ডায় মেতে ওঠেন। বিকেল থেকে দেখা যায় বিভিন্ন বয়সের মানুষের চায়ের আড্ডা। সারা দিনের কাজ শেষে এক কাপ চা আর সুরমার শীতল হাওয়া সত্যি সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। আরও রয়েছে চটপটিসহ বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান।
হাজারটা কাজ থাকলেও চেষ্টা করি সন্ধ্যার পরে কিন ব্রিজে যাওয়ার। সিলেটের ঐতিহ্য এই ব্রিজ এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকুক।
সভাপতি, সিলেট বন্ধুসভা