কালের সাক্ষী পটিয়া ক্লাবের মোস্তাফিজুর রহমান পাঠাগার

পটিয়া ক্লাবের মোস্তাফিজুর রহমান পাঠাগারে বই পড়ছেন পাঠকেরাছবি: লেখকের সৌজন্যে
তবে দীর্ঘদিন ধরে পাঠাগারটি বন্ধ। পটিয়া ক্লাবে গেলে পাঠাগারে পুরোনো দিনের বেশ কিছু মূল্যবান বই চোখে পড়ে। জরাজীর্ণ বুকশেলফ, চেয়ার, টেবিল, আলমারি আজও সজ্জিত।

বই পড়া নিয়ে ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, ‘রুটি–মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে; কিন্তু বইখানা অনন্তযৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ আর বই যদি অনন্তযৌবনা হয়, তাহলে পাঠাগার হবে একটি বাতিঘর। স্কুলবেলায় চট্টগ্রামের কালের সাক্ষী অমর বইঘরে গিয়ে অর্ধেক মূল্য পুরোনো বই সংগ্রহ করতাম। যখন কোনো পাঠাগার থেকে কিংবা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে পড়ার জন্য বই সংগ্রহ করতাম, তখন নিজের কাছে মনে হতো বই নয়, যেন আনন্দমিশ্রিত আলো সংগ্রহ করছি। সেই বই নিজে পড়ে আবার স্কুলের সহপাঠীদের পড়তে দিতাম। তখন বই সংগ্রহ করে পড়ার মধ্যে আনন্দ ছিল। স্মৃতির ঝাঁপিতে আজও গেঁথে আছে। আজ পটিয়া ক্লাবের বাতিঘর, মোস্তাফিজুর রহমান পাঠাগারের শুরুর দিকের গল্প শোনাব।

চট্টগ্রামের পটিয়া থানার মোড় থেকে শহীদ আবদুস ছবুর রোড দিয়ে কিছুদূর গেলে চোখে পড়বে পটিয়া ক্লাব রোড। পটিয়া ক্লাব ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে ক্লাবের ভেতর একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন আলাদাভাবে পাঠাগারের সদস্য হওয়া লাগত। ক্লাবের আজীবন সদস্যরা মূলত পাঠাগারের পাঠক। সদস্য হতে হলে ৫০ টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করতে হতো। আবার মাসিক চাঁদা ছিল ৫ টাকা।

সাতবাড়িয়া গ্রামের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন পটিয়া ক্লাবের আজীবন সদস্য। তিনি একসময় পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। সমগ্র চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় এটি সবচেয়ে পুরোনো পাঠাগার। ১৯৪৬ সালের কথা, ২৬ জুলাই মোস্তাফিজুর রহমান প্রায় ১৭৬টি ইংরেজি বই ও ৩৯৫টি বাংলা বই, অর্থাৎ মোট ৫৭১টি বই পাঠাগারের জন্য দান করেন। প্রথম দিকে পাঠাগারের পাঠকসংখ্যা ছিল খুব কম। ধীরে ধীরে পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ থেকে ৩০ জন হয়। পাঠাগারটির গঠনতন্ত্রও ছিল। দৈনিক আজাদী, দৈনিক ইত্তেফাক ও দ্য ডেইলি অবজারভার থাকত নিয়মিত। ১৯৫৫ সালের কথা, হঠাৎ করে ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান না ফেরার দেশে চলে যান।

১৯৫৯ সালের দিকে পটিয়া ক্লাব কর্তৃপক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানের সম্মানার্থে পাঠাগারটির নামকরণ করে মোস্তাফিজুর রহমান পাবলিক লাইব্রেরি নামে। সে সময় লাইব্রেরিটিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারের বেশি। দিন দিন পাঠকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অনেকেই এসে বই নিয়ে যেতেন। আবার অনেকে এসে পত্রিকা পড়তেন। প্রতিবছর পাঠাগারের উদ্যোগে সেমিনার ও বিজয় মেলা অনুষ্ঠিত হতো। বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলার চিরাচরিত ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হতো। সে সময় প্রতিবছর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা অনুদান আসত।  গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বই বিতরণ করত ১৫০ থেকে ২০০টি। সদস্যরা পাঠাগার তত্ত্বাবধায়কের কাছে বইয়ের জামানত বাবদ ১০-২০ টাকা দিয়ে খাতায় এন্ট্রি করে বই বাসায় নিয়ে যেতেন। বই পড়া হলে তা পাঠাগারে ফেরত দিয়ে যেতেন।

পটিয়া ক্লাবের আজীবন সদস্য নুরুল আলম জানান, সে সময় পাঠাগারের সভাপতি থাকতেন পদাধিকারবলে পটিয়া থানার সাবডিভিশনাল অফিসার অথবা সার্কেল কর্মকর্তা। পাঠাগারটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন এসডিও শফিকুল ইসলাম এবং পরবর্তীকালে সিও হায়দার আলী। পটিয়ার প্রাণ ছিল মোস্তাফিজুর রহমান পাঠাগার। সেখানে বইপোকাদের আড্ডা থাকত সব সময়।

তবে দীর্ঘদিন ধরে পাঠাগারটি বন্ধ। পটিয়া ক্লাবে গেলে পাঠাগারে পুরোনো দিনের বেশ কিছু মূল্যবান বই চোখে পড়ে। জরাজীর্ণ বুকশেলফ, চেয়ার, টেবিল, আলমারি আজও সজ্জিত। ক্লাবের বর্তমান পাঠাগার সম্পাদক আবুল বাশার বলেন, ‘পাঠাগারটি আমাদের ক্লাবের প্রাণ। তবে এখানে আগের মতো বইপ্রেমীরা ভিড় করেন না। পাঠাগারটির আধুনিকীকরণের জন্য আরও নতুন বই ও পত্র–পত্রিকা দিয়ে সজ্জিত করছি, যাতে তরুণেরা এসে নিয়মিত বই ও পত্র–পত্রিকা পাঠ করতে পারেন।’ ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে বইপ্রেমীদের প্রত্যাশা, পাঠাগারটি যেন সর্বস্তরের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। পটিয়া ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সরওয়ার কামাল রাজিব বলেন, ‘পটিয়া ক্লাবের মোস্তাফিজুর রহমান পাঠাগারটি সত্যি একটি ইতিহাস। আমার বাপ-চাচারা এখানে এসে নিয়মিত বই পড়তেন। মালঞ্চের সাহিত্য সভাগুলো একসময় এই পাঠাগারে আয়োজিত হতো। এখান থেকে অনেক আলোকিত মানুষ বের হয়েছেন।’

পটিয়া ক্লাবের বাতিঘর মোস্তাফিজুর রহমান পাঠাগারটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। পাঠাগারের শেলফগুলোয় স্তরে স্তরে সাজানো আছে বই। কিন্তু আগের দিনের মতো নেই পাঠক। সামনে মোস্তাফিজুর রহমানের নামে যে সাইনবোর্ড ছিল, সেটিও নেই।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা