অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘তারুণ্য’ যৌবনের জয়গাথা

লেখাটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অন্নদাশঙ্কর রায়

অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ তারুণ্য। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত শীর্ণকায় এই প্রবন্ধগ্রন্থটিতে লেখক আদ্যন্ত যৌবনের জয়গান গেয়েছেন। গ্রন্থটির ভূমিকার অংশে লেখক জানিয়েছেন তাঁর বিলেত বাসকালে দেশ-বিদেশে তারুণ্যের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছিল; সেই আন্দোলন ছিল পুরোনোর বিরুদ্ধে, বার্ধক্যের বিরুদ্ধে, জরার বিরুদ্ধে। লেখক সেই সময় যৌবনের পক্ষে লেখনী ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। আজ প্রায় শতবর্ষ পরও তারুণ্য-এর বার্তা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে; যখন পুরোনোপন্থীরা আবার নিয়মের নিগড়ে উজ্জ্বল উদাম যৌবনশক্তিকে শৃঙ্খলে বাঁধতে জোট বেঁধেছে, তখন সমাজের স্বার্থে, সময়ের স্বার্থে শৃঙ্খলমুক্তির জয়গান রচনা হয়ে পড়েছে অপরিহার্য।

পুরোনোপন্থীরা একটি বাঁধাধরা জীবনপথে বিশ্বাস রাখেন। সন্তানসন্ততির বিকাশ নিয়ন্ত্রিত হোক সেই নির্দিষ্ট পথের রেখা ধরে, তা তাঁরা আকুলভাবে কামনা করেন। সেই পথ থেকে কোনো রকম বিচ্যুতি তাঁদের কাছে নিতান্ত চিন্তা ও উদ্বেগের। কিন্তু পূর্বপুরুষের নির্ধারিত পথ কখনো তরুণের পথ হতে পারে না।

তরুণ দল নিজেদের পথ নিজেরাই খুঁজে নেবে। কারণ, সৃষ্টির স্বাধীনতাই তাকে ‘মানুষ’ করেছে। সেই কারণেই সে চালিত হয় চিন্তা ও চেতনার দ্বারা। নাহলে জগৎ-সংসারের অপর প্রাণিকুলের সঙ্গে মানুষের কোনো পার্থক্য থাকে না। মানবশিশু জন্মলগ্ন থেকেই পারিবারিক পরিসরে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে যে বাক্যবন্ধটি তা হলো, ‘অমুকের মতো হও’; প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাও তাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করে; অর্থাৎ একপ্রকার দাস মনোবৃত্তির হাতেখড়ি ঘটে শৈশবকালেই। লেখক এই প্রবণতাকে চিহিৃত করেছেন ‘মেরুদন্ড বাকিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা’ রূপে; যা প্রাথমিকভাবে শিশুকে গুরুজনের পায়ের তলে ও পরবর্তী সময়ে বিশ্বসংসারের পায়ের তলে উপনীত হওয়ার যোগ্য করে তোলে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে পারিবারিক অন্তির দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয় পরবর্তী প্রজন্মের ওপর; যেন পূর্বপুরুষের অপ্রাপ্তিজনিত বেদনার পরিশোধই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য। লেখকের মতে, এটি হলো পরিষ্কার অনধিকারচর্চা। যৌবনের গতিপথ খরস্রোতা পার্বত্য নদীপথের মতো; যা পারিপার্শ্বিক বাধাবিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে আপন লক্ষ্য স্থির করে নেয়। যৌবনধর্মের একমাত্র লক্ষণ প্রাচুর্য। সে কেবল প্রাণে বাঁচে না, সে প্রাচুর্যে বাঁচে। প্রাচুর্যই তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য। কঠিনতম কাজই হবে তার পৌরুষের পরিচয়; সহজলভ্য কিছু নয়, অসম্ভব, অসাধ্যকে লাভ করাই হবে তার লক্ষ্য। তবেই সে কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাবে; পৃথিবীতে তার যথার্থ স্থান বুঝে নিতে পারবে। যা সহজে পাওয়া যায়, তার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। তা একপ্রকার অনৈতিকতার দিকেই যুবসমাজকে চালিত করে।

বলা বাহুল্য, এই তারুণ্য বা যৌবনধর্ম এখানে কোনো বিশেষ বয়সকালকে নির্দেশ করছে না। এটি ইঙ্গিত করেছে একটি মানসিকতার, একটি মনোবৃত্তির; যাকে ব্যবহার করা যেতে পারে সুষুপ্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার টনিক হিসেবে কিংবা জরা নামক ব্যাধির উপশম রূপে। এই তারুণ্যের গোড়ার কথা রচনা করে যে দুটি বিষয় তা হলো, প্রতিভা ও প্রেম। প্রতিভাকে যেমন আটকে রাখা যায় না, অঙ্কুরের মতো সব সীমা অতিক্রম করে প্রকাশ পায়; তেমনই উপযুক্ত প্রতিবেশ পেলে প্রতিভাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে উঠতে পারে। একই কথা প্রযোজ্য প্রেমের প্রসঙ্গেও। প্রেমের পরিসরকেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা করে রেখেছে সংকীর্ণ। ফলে সেখানেও প্রতি পদে এসে দাঁড়ায় বঞ্চনা। ভালোবাসার প্রথম শর্ত স্বাধীনতা। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে এই উপমহাদেশের তরুণ দল এমন এক সমাজব্যবস্থা লাভ করেছে, যেখানে সংযমকে গণ্য করা হয় চূড়ান্ত পুরুষকার রূপে আর সতীত্ব হলো নারীত্বের একমাত্র লক্ষ্য। এই ব্যবস্থায় নারী হলো দেহসর্বস্ব; যেখানে শরীরকে রক্ষা করতেই তার সব প্রযত্ন নিঃশেষিত হয়ে যায়। অথচ সতীত্ব ও নারীত্ব পরস্পর বিপরীতধর্মী; সতী প্রাণহীন, তার বিদ্রোহ নেই, স্বাতন্ত্র্য নেই, সৃষ্টি নেই, স্বাদ নেই। এখানে স্বামী নামক ধারণাটিও একটি প্রেমহীন, নৈর্ব্যক্তিক ধারণা; যে ধারণার বশবর্তী হয়ে নারীকুল ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ মধুর প্রেম সর্বদাই ব্যক্তিসর্বস্ব। কিন্তু এই সমাজ প্রেমকে অবিশ্বাস, অসম্মানের চোখে দেখেছে। সে কারণে পুরুষ ও নারী, উভয় ক্ষেত্রেই দেহ ও মনের সমন্বয় ঘটেনি। ফলে এরূপ প্রেমহীন সমাজ জন্ম দিয়েছে এক পাকা চুলতন্ত্রের, বৃদ্ধরূপ জরার প্রতি অহেতুক শ্রদ্ধার; যে জরা মরার চেয়েও ভয়ংকর। জীবনের চেয়ে যৌবনের মূল্য বেশি। তাই তারুণ্যের আহ্বান অনিবার্য। এটিকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, মহারাজা নন্দকুমার মহাবিদ্যালয়, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত