একসময় সিনেমা হলে যাওয়া ছিল উৎসবের মতো ব্যাপার। গ্রামের মানুষ কোমরে চিড়া-মুড়ি বেঁধে, গরুর গাড়িতে চড়ে, কখনো পদ্মা পেরিয়ে শহরে যেতেন শুধু একটা সিনেমা দেখার জন্য। সিনেমার নাম ‘রূপবান’।
১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্র আজ ৬০ বছরের প্রবীণ, কিন্তু এখনো জীবন্ত। এই সাফল্য শুধু টাকার অঙ্কে নয়, বরং এক জাতির সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে, আবেগে আর মায়ের আঁচলে লুকানো ভালোবাসায়।
‘রূপবান’ ছিল মূলত এক লোকগাথা, যে গল্প শত শত বছর ধরে বেঁচে ছিল গ্রামীণ যাত্রামঞ্চে, পালাগানে, দোতারা-ঢোলের তালে। পরিচালক সালাহউদ্দিন সেটিকে সেলুলয়েডে তুলে আনেন আর এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেন বাংলা চলচ্চিত্রে।
তখন বাংলা সিনেমা ধুঁকছিল উর্দু ছবির চাপে। বাণিজ্যিক ব্যর্থতার ভয়ের কারণে প্রযোজকেরা উর্দু ছবির প্রযোজনায় ভিড় করেন। কিন্তু ‘রূপবান’ এসে সেই প্রবাহ ঘুরিয়ে দেয়। দর্শক আবার ফিরলেন নিজের ভাষার গল্পে, নিজের মাটির গন্ধে।
চলচ্চিত্রটি আসলে এক মায়ার কাহিনি; বারো দিনের এক নবজাতক স্বামী আর বারো বছরের এক কিশোরী স্ত্রী। নাম তার রূপবান। সে শুধু এক কিশোরী নয়, সে ত্যাগের, দায়িত্বের আর অদ্ভুত কোমল মানবিকতার এক প্রতিচ্ছবি। যেভাবে একজন মেয়ে এক নবজাতককে বুকে আগলে মানুষ করে তোলে, সেটি এক অর্থে আমাদের সমাজের ‘মায়ের চিত্র’।
এই গল্পে মাতৃত্ব, প্রেম আর কর্তব্য একাকার হয়ে গেছে। তাই এটি দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছে চিরদিনের জন্য। ‘রূপবান’ হয়ে উঠেছিল সেই সময়ের সংস্কৃতি। তখন বাজারে ছিল রূপবান সিগারেট, রূপবান আলতা, এমনকি রূপবান নামের ঘুমের বড়ি পর্যন্ত! মানুষ সিনেমা হলে রাত কাটিয়েছে, টানা তিন শো দেখে কেঁদেছে আর শহরে–গ্রামে সবাই মুখে মুখে গেয়েছে—
‘ও দাইমা, কিসের বাদ্য বাজে গো…’
চলচ্চিত্রটির সংগীত পরিচালক ছিলেন সত্য সাহা। আবদুল আলীম আর নীনা হামিদের গলায় গানগুলো আজও সময়ের গায়ে হালকা কাঁপন তোলে। তন্দ্রা মজুমদার এই সিনেমার মাধ্যমেই ‘সুজাতা’ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বাঁশে হাত রেখে গান গাওয়ার দৃশ্যটি যেন আজও লোকমুখে ভেসে বেড়ায়। শোনা যায়, সেই বাঁশটি নিলামে বিক্রি হয়েছিল ৬০ টাকায়! যে সময় এক আনার দামই ছিল অনেক।
সুজাতা হঠাৎই হয়ে ওঠেন ‘রূপবান–কন্যা’—যে নাম ছাপিয়ে গিয়েছিল তাঁর নিজের পরিচয়কেও। এমন জনপ্রিয়তা আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে বিরল।
পোস্টারশিল্পী বিদেশ কুমার ধর তখন ছিলেন কিশোর। ‘রূপবান’-এর ব্যানার আঁকার কাজটি পেয়েছিলেন ‘জুপিটার পাবলিসিটি’ থেকে। সাদা–কালো রঙে আঁকা সেই ব্যানার নাকি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে গুলিস্তান সিনেমা হলের বাইরে মানুষ শুধু সেটির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত।
২০০৫ সালে পরিচালক ছটকু আহমেদ ‘আজকের রূপবান’ নির্মাণ করেন ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে। ফ্রান্সের প্যারিসে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল, প্রশংসাও পেয়েছিল। তবু কেউই আর ১৯৬৫-এর সেই জাদু ফিরিয়ে আনতে পারেননি। কারণ, ‘রূপবান’ ছিল একটি সময়, এক অনুভব। যেখানে দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে শুধু গল্প দেখেননি, নিজেদের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন।
আজ যখন কনটেন্টের যুগে ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, টিকটকের ভিড়ে গল্প হারিয়ে যায় কয়েক সেকেন্ডে, তখনো ‘রূপবান’ মনে করিয়ে দেয়—একটি গল্প, যদি হৃদয় থেকে বলা হয়, তবে সেটি সময় পেরিয়েও বেঁচে থাকে।
বন্ধু, রাজশাহী বন্ধুসভা