বৈশাখে যেমন তীব্র দহন, তেমনি আকাশে মেঘের লুকোচুরি। আর কালবৈশাখী যেন এর অনিবার্য সাথি। তবু মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র লিখেছেন, ‘বৈশাখ এদেশে বড় সুখের সময়...’। আবার কে না জানে বৈশাখের রহস্যময়তা কথা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ওই বুঝি কালবৈশাখী/ সন্ধ্যা আকাশ দেয় ঢাকি।…’ এদিকে বৈশাখের সেই কালজয়ী গান, ‘এসো এসো এসো হে বৈশাখ’–এর সুর শহর, বন্দর, গ্রাম একাকার করে বেজে ওঠে। রংবেরঙের পোশাকে সাজে নারী, পুরুষ ও শিশুরা। রঙিন ফুলে ভরে যায় দেশ। বৈশাখ নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘কাল বৈশাখী আসিলে হেথায় ভাঙিয়া পড়িত কোনো সকাল...।’
বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। এর সঙ্গে রয়েছে জীবনের বন্ধন। এটা বাঙালির সর্বজনীন লোকজ উৎসব। পয়লা বৈশাখে সূর্যোদয়ের পর ছায়ানটের শিল্পীরা সংগীতের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। বর্ষবরণের এ অনুষ্ঠান ঢাকার রমনার বটমূলে হয়। স্থানটি বটমূল নামে পরিচিত। কিন্তু যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয়, সেটি বটগাছ নয়, অশ্বত্থগাছ। ইউনেসকো বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
বৈশাখ বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর উৎসব নয়। এটা আমাদের জাতিসত্তার উৎসব। এ উৎসব সবার, সর্বজনীন।
বাংলা বছরের শেষ মাস চৈত্র। আর প্রথম মাস বৈশাখ। এ দুটি মাস যেন একসূত্রে গাঁথা। বিশেষ করে সনাতন ধর্মের মানুষ চৈত্রের শেষ দিনটিতে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে। এদিন নিরামিষ খায়। নতুন বছরের ফল দিয়ে উপাসনা করে। মনে করা হয়, প্রথম দিনটি ভালো কাটলে সারা বছরই ভালো যাবে। সংক্রান্তির পরের দিনটি পয়লা বৈশাখ। এদিন মানুষ খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। নতুন কাপড় পরে। আত্মীয় ও বন্ধুদের বাড়িতে যায়। বাড়িঘর সাজায়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকে। কয়েক গ্রাম মিলে কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করে বৈশাখী মেলা। একজন আরেকজনকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। মেলায় থাকে নানা রকম কুটিরশিল্প পণ্য। থাকে পিঠাপুলির আয়োজন। অনেকে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খায়।
কিন্তু বৈশাখসহ এ দেশের নানা ঐতিহ্যের অনুষ্ঠান বিদেশি সংস্কৃতি ও বহুজাতিক কোম্পানি নষ্ট করেছে। শহর, গ্রামবাংলার আনন্দঘন অনুষ্ঠানে ঢুকেছে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য। তাই সাধারণ মানুষ আর আগের দিনের মতো উৎসব করতে পারে না। আমাদের অনেক সংস্কৃতি এখন আর প্রায় নেই বললেই চলে।
সেকালে মানুষের জীবনে কিছুটা অবসর ছিল। আধুনিক জীবনব্যবস্থা এখন সেটা কেড়ে নিয়েছে। ছোটবেলায় এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে রাতভর পালাগানসহ নানা অনুষ্ঠান দেখা যেত। বাড়িতে বাড়িতে অনুষ্ঠান করে চাল, ডাল, টাকাপয়সা সংগ্রহ করে সবাই মিলে আনন্দভোজের আয়োজন করত। এখন সেসব সংস্কৃতি প্রায় নেই বললেই চলে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষও পয়লা বৈশাখ পালন করেন। চাকমা সম্প্রদায়ের কাছে নববর্ষের নাম ‘বিজু’। মারমাদের কাছে ‘সাংগ্রাই’। ত্রিপুরাদের কাছে ‘বিসু’।
সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকে এ জনপদের সংস্কৃতির ওপর আঘাত এসেছে। নানা সংকট মোকাবিলা করেও আমাদের ঐতিহ্য টিকে আছে। ভাষার ওপর আঘাত এসেছে। জীবন দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা হয়েছে। বৈশাখ এ দেশের ঐতিহ্যের বড় একটা অংশ। ষাটের দশক থেকে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। একইভাবে আশির দশকের শেষ দিক থেকে শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে শুরু হয় এ শোভাযাত্রা। বিভিন্ন সড়ক ঘুরে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় নানা উপকরণে তুলে ধরা হয় আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। শোভাযাত্রা আবার প্রতিবছর একই রকম হয় না। একেক বছর একেক থিম থাকে। বিচিত্র অনুষ্ঠানে ভরপুর থাকে সারা দিন। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী সব শ্রেণির মানুষ সূর্য ওঠার আগেই নেমে আসে পথে। অংশ নেয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। বৈশাখের ভোরে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় বর্ণাঢ্য পোশাকে শত শত মানুষের পথচলার দৃশ্য। লোকশিল্পীর নকশা আর রংবেরঙের পোশাকে রঙিন হয়ে ওঠে প্রভাত।
এ জনপদের মানুষের রয়েছে হাজার বছরের সংস্কৃতি। সংস্কৃতিই আমাদের পরিচয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এর রূপান্তর হয়েছে। একসময় স্বর্ণ ব্যবসায়ীর হাত ধরে শুরু হয়েছিল যে হালখাতা, সময়ের সঙ্গে সেটা হয়েছে সর্বজনীন। বৈশাখের প্রথম দিন বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
শুধু ঢাকায় না, সারা দেশেই বৈশাখবরণ অনুষ্ঠান হয়। নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্রের তালে মেতে ওঠে মানুষ। বৈশাখ ঘিরে জনপদজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড়, হাডুডু খেলাসহ নানা অনুষ্ঠান। এক দিন, দুই দিন—কোথায় কোথায় সপ্তাহ ধরে মেলা বসে। এসব মেলায় দা, বঁটি, খুন্তি, কোদাল, কাস্তে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি বাঁশ ও বেতের তৈরি ঝুড়ি, ধামা, কুলা, চালুনি ইত্যাদি পাওয়া যায়। আবার হাতপাখা, পুতুল, বাঁশি, বেলুন, ঢোল, ডুগডুগি, ফিতা, পুঁতির মালা, কাচের চুড়ি, ইমিটেশনের গয়নাসহ নানা শখের পণ্য মেলায় পাওয়া যায়।
বৈশাখে পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ও গানের আসর বসে। বাউলগান, লোকগান, মারেফতি, ভাটিয়ালিসহ নানা ধরনের গান বাঙালির বৈশাখকে আনন্দমুখর করে তোলে। আবার তালপাতার বাঁশির সুরে অনেকে ফিরে যায় কল্পনার শৈশবে। গ্রামের অবহেলায় পড়ে থাকা মাঠে যেমন বৈশাখী মেলা হয়, তেমনি শহরের অভিজাত এলাকার ভবনে-রেস্টুরেন্টে মেলা হয়।
অথচ কিছু মানুষ আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তারা আমাদের জীবনবোধে বিভেদ তৈরি করছে। বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কখনো কখনো এ অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়। এসব আমাদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। এই ভিন্নতার দেয়াল দূর করতে হবে। এ দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে ষড়যন্ত্র করে কেউ সফল হয়নি। একসময় তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। অসত্য, অসুন্দরকে কখনো প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অসত্য ইতিহাস কখনো সত্যের সামনে টিকে থাকে না। বৈশাখ বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর উৎসব নয়। এটা আমাদের জাতিসত্তার উৎসব। এ উৎসব সবার, সর্বজনীন। কারও বিশ্বাসে আঘাত বা অসম্মান করে নয়, বরং যুক্তি দিয়ে এর সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সব বিভেদ ভুলে সবাই একসঙ্গে বৈশাখ পালন করতে হবে। তাহলে আমরা শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাব।
বাংলা সনের কথা…
কৃষির সঙ্গে বাংলা নববর্ষের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এখানে বিভিন্ন ঋতুতে ফসলের চাষ হয়। অনেক অনেক বছর আগে বাংলা সন বলে কিছু ছিল না। তখন ছিল আরবি হিজরি সন। হিজরি সনকে চান্দ্র সনও বলে। কিন্তু এই চান্দ্র সন পূর্ণ হয় ৩৫৪ দিনে। এদিকে সৌরসন হয় ৩৬৫ দিনে। এভাবে প্রতি ৩৩ বছরে চন্দ্র সময় এক বছর বেড়ে যায়। তাই চান্দ্র সনে রাজাদের খাজনা আদায়ে জটিলতা দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানের ভাবনা থেকে বাংলা সনের আবির্ভাব হয়। বাংলা সনের ইতিহাস জানতে হলে কয়েক শ বছর পেছনে যেতে হবে। একই সঙ্গে ফিরে দেখতে হবে ভারত বর্ষে মোগল শাসনের ইতিহাস।
সেটা ছিল ১৫২৬ সাল। তখন ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে পানিপথ নামের এক গ্রাম ছিল। সেই গ্রামে ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে যুদ্ধ হয় মোগল সম্রাট বাবরের। যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদি পরাজিত হন। তখন থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল অংশজুড়ে মোগল সম্রাজ্যের সূচনা হয়। বাবরই হলেন মোগল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন একজন ফারসিভাষী মুসলিম। ‘মুঘল’ শব্দটি এসেছে ‘মঙ্গোল’ থেকে। ইতিহাসের নিষ্ঠুর শাসক চেঙ্গিস খান বাবরদের পূর্বপুরুষ। তৈমুর খান তাঁর দাদা। তৈমুর খানও নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন। তিনি ১৪১১ থেকে ১৪৪৯ সাল পর্যন্ত মধ্য এশিয়া শাসক ছিলেন।
পাঁচজন প্রধান মোগল সম্রাট ভারত উপমহাদেশ শাসন করেন। বাবর, তাঁর সন্তান হুমায়ন, হুমায়নের সন্তান আকবর, আকবরের সন্তান জাহাঙ্গীর, জাহাঙ্গীরের সন্তান শাহজাহান, শাহজাহানের সন্তান আওরঙ্গজেব। আকবরের সময়টা ছিল মোগল শাসনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়। তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল হিজরি ও সৌরসন চালু ছিল। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য ফসল উৎপাদনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা দিতে বাধ্য করা হতো। এ জন্য মোগল সম্রাট আকবর এমন একটি সন তৈরির চিন্তা করেন, যেটা ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করতে পারে।
তখন ১৫৮৪ সাল। সে বছরের ১১ অথবা ১২ মার্চ ঘটে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তখন মোগল সম্রাট আকবরের রাজদরবারে ফতেহউল্লাহ খান সিরাজি নামের এক বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁকে তিনি হিজরি ও সৌরসনের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেন। তিনি সফলতার সঙ্গে সমন্বিত সন চালুর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। প্রথমে এর নাম ছিল ফসলি সন। এটাই হলো আকবরের চালু করা বাংলা সন। ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর আকবর সিংহাসন আরোহণ করেন। এদিন থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়।
আকবরের সময় থেকে পয়লা বৈশাখ শুরু হয়। পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা উৎসবের আয়োজন করতেন। সবার মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করতেন। এটা ধীরে ধীরে একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে রূপ নেয়। তখন এদিনের একটা অন্যতম বিষয় ছিল দোকানের হিসাব হালনাগাদ করা। এদিন হালখাতা খোলা হতো। দোকানিরা ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। কারও কাছে কোনো পাওনা থাকলে পরিশোধ করা হতো।
তবে আকবরই যে বাংলা সন চালু করেন, এটা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। বাংলা একাডেমির প্রয়াত মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের মতে মোগল সুবেদার মুর্শিদ কুলি খান বাংলা সনের সূচনা করেন। এমন আরও কিছু মত আছে। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সম্রাট আকবরই বাংলা সন চালু করেন।
সে সময় ১২ মাসের নাম ছিল যথাক্রমে কারবাদিন, আর্দি, বিসুয়া, কোর্দাদ, তির, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম ইস্কান্দার ও মিজ। কিন্তু প্রায় কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে কীভাবে এসব নাম পরিবর্তিত হয়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র হয়েছে। অনেকে ধারণা করেন, ১২টি নক্ষত্রের নাম নিয়ে বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়। বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং নক্ষত্র চিত্রা থেকে চৈত্র।
বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে এক কমিটি হয়। এ কমিটি পুরোনো বাংলা সন সংশোধন করে। প্রথম পাঁচ মাসকে ৩১ দিন, আর অন্য মাসগুলোকে ৩০ দিন করা হয়। ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনপঞ্জি গ্রহণ করা হয়। বাংলা একডেমি সেটাই ব্যবহার করে। সে হিসেবে ১৪ এপ্রিল আমাদের পয়লা বৈশাখ।
আশফাকুজ্জামান: লেখক ও গবেষক