পরিচালক আবু আকতারুল ইমানের ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ একটি দেশাত্মবোধক চলচ্চিত্র। তবে অন্য অনেক দেশাত্মবোধক চলচ্চিত্রের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার। আমরা নিজেদের জন্মভূমিকে ভালোবাসি। সুর ভালোবাসি, গান ভালোবাসি, কবিতা ভালোবাসি। জন্ম থেকেই কিছু সুর, গান বা কবিতা আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমের শিকড় ছড়িয়ে দেয়। কবি, শিল্পীদের সেসব অমূল্য কালজয়ী রচনা আমাদেরকে দেশের প্রতি অনুরাগী করে তোলে। অধিকাংশ দেশাত্মবোধক চলচ্চিত্রে সেসব আবহমানকালের সুরগুলো বেজে উঠলে আমরা ভেসে যাই।
সৃষ্টিশীল মানুষেরও একটা দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা থাকে। অতীতে যাঁরা ইতিহাস হয়েছেন, তাঁদের শ্রদ্ধা করা, তাঁদের ধারাকে বজায় রাখা। পাশাপাশি নতুন কিছু করে যাওয়া। দেখা যাবে, নতুন সৃষ্টির দশটির মধ্যে নয়টি মহাকালের ছাঁকনিতে ছেঁকে হারিয়ে গেছে, কিন্তু যে একটি সৃষ্টি থেকে গেছে, সেটাও কালজয়ী ইতিহাস। এখন আমরা সবকিছুই সাম্প্রতিক সময়ের প্রচার, প্রসার ও জনপ্রিয়তা দিয়ে বিচার করি। কিন্তু মহাকালের ছাঁকনি এমনই, সাম্প্রতিক সময়ের তুখোড় জনপ্রিয়তাও হারিয়ে যেতে পারে। আবু আকতারুল ইমানের ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ এ কারণেই ব্যতিক্রমী; প্রচলিত কোনো সুর এখানে আসেনি। সব সুর, সব গান নতুন করে বোনা হয়েছে। শরণার্থীশিবিরের নৈশ আসরে একজনের শুধু খালি গলায় নিজের মতো করে একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান ছুঁয়ে গেছে। আবার সুর না থাকাতে দেশপ্রেমের আবেগ জাগাতে কোথাও কিন্তু এতটুকু ব্যর্থ হয়নি এই চলচ্চিত্র।
মানুষের জীবনে চিরাচরিত ধর্মের প্রভাব বলা হয়ে থাকে, যা মানুষকে ধারণ করে, তা–ই হলো ধর্ম। আর ধর্মকে অসৎ পথে ব্যবহার করে কিছু স্বার্থসন্ধানী মানুষের উগ্র কার্যকলাপ, যা ধর্ম সম্পর্কে যেমন ভুল ধারণা দেয়, মানুষকে মানুষবিরোধী, দেশবিরোধী, মানবতাবিরোধী করে তোলে, নিজের এবং দশের সর্বনাশ ডেকে আনে—এই চলচ্চিত্রে সুন্দরভাবে তা তুলে ধরা হয়েছে। চলচ্চিত্রে জঙ্গিদের মুখে সংলাপ শুনে অনেকের মনে হতে পারে, ধর্মের ওপর আঘাত আনতে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে; পরিচালক অত্যন্ত সতর্ক হয়ে প্রথমেই তাই ধর্মের মানবতাবাদী বাণী প্রচার করেন। আল কোরআনের সুরা আল-মায়িদাহ, আয়াত ৫৪৩২: তিনি দর্শকের সামনে তুলে আনেন। আয়াতের অর্থ হলো, ‘যে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল এবং যে একজন নিরপরাধ ব্যক্তির জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই রক্ষা করল।’ সুতরাং ধর্ম–অধর্মের পথ কিন্তু শুরু থেকেই একেবারে স্বচ্ছ।
ভারতের করণ জোহর বিশিষ্ট অভিনেতা শাহরুখ খানকে সামনে রেখে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন—‘মাই নেম ইজ খান’। সেই চলচ্চিত্রের বিখ্যাত সংলাপ স্বয়ং শাহরুখের মুখে, ‘মাই নেম ইজ খান, অ্যান্ড আই এম নট আ টেররিস্ট।’ ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ চলচ্চিত্রে শাফায়েত চরিত্রে অভিনয় করা খিজির হায়াত খানও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ডাক্তার চরিত্রে অভিনয় করা শানারেই দেবী শানুকে প্রথম দেখাতে অভয় দিয়ে বলেন, ‘আমি একজন জার্নালিস্ট, আই এম নট আ টেররিস্ট।’
লাদেন দ্বারা আমেরিকা আক্রান্ত হওয়ার পরে গোটা বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের চোখে যখন আমেরিকার নিরীহ মানুষের জন্য জল ঝরছে, তখন উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ রকমই একটা ধারণা জন্মাতে শুরু করেছিল যে মুসলমানমাত্রই জঙ্গি। কিন্তু আমরা জানি, আমাদের পাড়ার যে চাচা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, স্কুলে গিয়ে ছাত্র পড়ান, দলমত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রতিবেশীর দুঃখে পাশে গিয়ে দাঁড়ান, তিনি কখনই উগ্রতাকে প্রশ্রয় দেন না। আল্লাহর সেবা করেন। তবু সমাজে কিছু উগ্র মানুষ রয়েছে। তারা আদৌতে ধর্মেরই ক্ষতি করে চলেছে। মানুষের মূল শত্রু তার অভাব। চরম অভাব থেকেই মানুষ হয়ে পড়ছে হতাশ, বিষণ্ন। আর এই দুর্বল জায়গাগুলোকে পুঁজি করে ধর্মের নাম করে মানুষকে অর্থের লোভ দেখিয়ে বিপথে চালিত করছে বড় একটা শ্রেণি। এমনভাবে তারা তরুণসমাজের মগজধোলাই করে চলেছে, আত্মঘাতী হতেও পিছপা হচ্ছে না সহজ–সরল নবীন কুঁড়িরা। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করে চলা এই শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করতেই ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ নামের কেন্দ্রীয় চরিত্রের আগমন।
খিজির হায়াত খান নামের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অভিনেতা জন এই চলচ্চিত্রের সম্পদ। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা শুধু নয়, এই ছবির গল্প তিনি বুনেছেন। হাসনাত পিয়াসের সঙ্গে মিলে সংলাপ, চিত্রনাট্যও সাজিয়েছেন। ব্যক্তিজীবনেও তিনি যে ধরনের চিন্তাভাবনার মানুষ, যে ধরনের দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন, গল্পের মধ্যেও সেটার প্রতিফলন। আবার আমাদের অনেকেরই টারজান বা স্পাইডারম্যান হওয়ার ইচ্ছা থাকে, বাস্তবে তা পেরে উঠি না বলেই কল্পনায় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের রূপ দিয়ে যাই। ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ সেদিক থেকেও এক নতুন চরিত্র।
আর যাঁরা অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র দেখতে চান, বেশ আনন্দ পাবেন এই চলচ্চিত্র দেখে। অ্যাকশনধর্মী ছবিরও মানুষের মধ্যে অনেক রকম প্রভাব আছে। সমাজের অপরাধজগতের মানুষেরাও অ্যাকশনধর্মী সিনেমা দেখে নিজেদের অপরাধের কৌশল খুঁজে পেতে, আর সাধারণ মানুষ অ্যাকশন দেখে নিজেদের ক্ষয়ে পড়া, ধসে পড়া জীবনে ভেতরের নায়কোচিত ভাবটাকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে। এ ধরনের ছবি সমাজে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। শান্তি ও সংহতির বার্তা দেয়।
শানুরেই দেবী শানু ও বিদেশিনী মারিয়ান চেমপক্স প্যালেগ্রিনকে এই চলচ্চিত্রে দেখতে যেমন সুন্দর লেগেছে, অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেদের সৌন্দর্যের সত্তা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। অন্য অভিনেতা ও কলাকুশলীরা হলেন টাইগার রবি, শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীব, হামিদুর রহমান, শামীম হাসান সরকার, সোলাইমান সুখন; শিল্পনির্দেশনায় মিথুন সরকার, পোশাক নির্দেশনা নাজনিন চৌধুরী, স্থিরচিত্র আসাদ আবেদীন জয়, রূপসজ্জা রতন সরকার, ফাইট নির্দেশনা এডওয়ার্ড এফ গোমেজ, ভিএফএক্স ও অ্যানিমেশন আজাজ জোহা, সম্পাদনা আবদুল্লাহ আল মামুন, কালার আশরাফুল আলম, সংগীত পরিচালনা নাজমুল আবেদীন (আবির), চিত্রগ্রাহক মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান ও সাচী চৌধুরী।
ছোটবেলায় চট্টগ্রাম শহরে প্রতি বুধবার রাতে বিটিভিতে ‘ম্যাকগাইভার’ দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম, আমরা আসলে তখন থেকেই প্রত্যেকেই মিস্টার বাংলাদেশ হয়ে উঠেছি।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত