হতাশা আর ক্লান্তির শহর ছেড়ে ছুটে যাওয়া প্রকৃতির কাছে। ভ্রমণ আমার আত্মার সঙ্গে মিশে আছে। তাই তো সুযোগ পেলেই ছুটে যেতে চাই পাহাড়-সমুদ্রে। বিয়ে করেছি সদ্য। বউ শুধু আবদার করে ঘুরতে নিয়ে যেতে। এদিকে ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর; বউ ভাবে আমি স্বার্থপর! আসলে সময়-সুযোগ হয়ে উঠছে না বলে যেতে পারি না। মিথ্যে বলে তো আর ফায়দা নেই। বউ বায়না ধরেছে সে ঘুরতে যাবেই। আমিও আশ্বাস দিতে কৃপণতা করিনি। অবশেষে দারুণ একটা সুযোগ এসে গেল। একই দিনে পাহাড়, ঝরনা ও সমুদ্রে বেড়ানোর।
চমৎকার বিষয় হচ্ছে আমাদের এ জার্নিটা ছিল তেরোজনের। ওরা এগারো, আমরা দুই। অধিকাংশই আমার শ্যালক-শ্যালিকা। মজার ব্যাপার হলো ১৪ আগস্ট বাসায় ফিরি রাত ১১টায়। ছোট শ্যালিকা টুম্পা তো রেগে আগুন! ভোর চারটায় উঠতে হবে। রওনা দিতে হবে ট্রেনে চড়ে। এদিকে বউয়ের ফোনের ওপর ফোন। আমি আড্ডায় মজে ছিলাম সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে। যা–ই হোক, রাত গড়িয়ে ভোর তখন চারটা। কোনোরকমে লালচে চোখ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। পাঁচটায় ট্রেন। প্রাণের শহর চাঁদপুর থেকে রওনা করব।
কাকঢাকা ভোর, তখনো সূর্য উঁকি দেয়নি। আমরা পৌঁছালাম চাঁদপুর কালীবাড়ি রেল জংশনে। চারদিক অন্ধকার। ঠিক ভোর পাঁচটায় মেঘনা এক্সপ্রেস হাজির। বগি নাম্বার ‘ঢ’। উঠে পড়লাম ওরা এগারো, আমরা দুই। যাত্রা কোথায় তখনো নিশ্চিত নই। কেবল এতটুকু জানি যে টিকিট কাটা হয়েছে ফেনী পর্যন্ত। রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম। ঝক ঝক ঝক ট্রেন ছুটে চলেছে। অনেকটা ফাঁকা ছিল ট্রেনের কামরা। যাত্রাপথে বেশ হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলাম। এগারো জনের মধ্যে দুজন মধুরোড থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। জয়া আর জয়।
সম্পা আমার সহধর্মিণী। তারই গ্যাং ওরা এগারোজন। এর মধ্যে জয় ও জয়া বাদে বাকি সবাই আমার শ্যালক-শ্যালিকা। মৌ, টুম্পা, পায়েল, আকাশ, নিঝুম, রিত্নি, বিন্তি, শীর্ষেন্দু ও নন্দন দা। বিন্তিকে দেখে অনেকেই ভেবেছিল সে বোধ হয় বিদেশি! আমিও এই সুযোগে একটু ভাব নিলাম। বলেছি, সে নিউজিল্যান্ডে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, আমাদের ট্রেনও গন্তব্যের দিকে ছুটছে। অবশেষে তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষে ফেনী পৌঁছালাম।
ফেনীতে নেমেই নাশতা খেতে হোটেলে ঢুকি। মহিপাল ফেনীর বিখ্যাত জায়গা। সেখান থেকেই বাসে উঠলাম। তখনো জানি না আমাদের গন্তব্য কোথায়। তবে এতটুকু নিশ্চিত ছিলাম যে পাহাড়ে যাচ্ছি।
অতঃপর রওনা দিলাম। পথিমধ্যে খৈইয়াছড়া ঝরনার সাইনবোর্ড দেখে ভাবলাম বোধ হয় এখানেই নামব। কিন্তু আমাদের আয়োজক জানাল গন্তব্য সহস্রধারা।
বাস থেকে নেমে সিএনজিযোগে ছুটে চললাম সহস্রধারার দিকে। পর্যটন স্পট হলেও রাস্তার অবস্থা তেমন ভালো নয়। একদিকে পাহাড়ি অঞ্চল, অন্যদিকে ভাঙা। আমরা পৌঁছালাম সহস্রধারা ঝরনার কাছে। ও মা, পাহাড়ের ওপরে উঠে দেখি সেখানে জলাশয়! এই জলকুণ্ড পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। জনপ্রতি ৮০ টাকা।
এদিকে বৃষ্টিও সুযোগ বুঝেছে। অবিরত ধারায় বর্ষণ শুরু হয়। একজন একজন করে হাত ধরে।
ছোট ইঞ্জিনচালিত বোটে উঠলাম। বোট থেকে নেমেই কর্দমাক্ত বাগান ডিঙিয়ে পৌঁছাই সহস্যধারা ঝরনায়। কয়েক শ ফুট উঁচু থেকে প্রাকৃতিক ঝরনার পানি নিচে আচড়ে পড়ছে। কী চমৎকার দৃশ্য! ঝরনার পানি যেমন শীতল, তেমনি এখানকার পরিবেশও মনোমুগ্ধকর।
সবাই ভিজলেও আমি, জয়া আর নন্দন দাদা ভিজিনি। সবাই যখন ডোবাচ্ছে ঝরনার পানিতে, তখন আমি ছবি আর ভিডিও করতে ব্যস্ত। বিন্তি তো রীতিমতো ঝরনার পানিতে হাবুডুবু খেয়ে একাকার। এ যেন বাঁধভাঙা আনন্দ। তাকে আটকে রাখা যায় না। মৌ, পায়েল, নিঝুমরাও কম নয়।
আমার বউ সম্পার তো দুদিকে যন্ত্রণা! মন চায় ভিজতে আবার মনে হয় যদি জ্বর আসে। চিন্তায় তিনি মগ্ন। এদিকে সময় যত যাচ্ছে, ততই আমাদের আনন্দগুলো ফিকে হয়ে আসছে। আকাশ জানাল, আমরা এবার সমুদ্রে যাব। ঝরনার জলে গা ভিজিয়ে রওনা দিলাম সীতাকুণ্ডের পথে। সিএনজিযোগে পৌঁছালাম সেখানে। সীতাকুণ্ড বেশ পরিচিত জায়গা। বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছি। সীতাকুণ্ড পৌঁছে দুপুরের খাবার খেলাম। সেখান থেকে গন্তব্য গুলিয়াখালি সী বিচ। আধা ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর যাত্রা। পৌঁছালাম সমুদ্রের তীরে। মাটি নরম বলে যেতে হলো বোটে। বিচে নেমেই মনে হলো কোনো দ্বীপপুঞ্জে এসে পড়লাম না তো! বিশাল জায়গাজুড়ে সবুজ ঘাসের সমারোহ। চমৎকার দৃশ্য। একদিকে সাগরের গর্জন, অন্যদিকে সবুজ ঘাসের সৌন্দর্য। লোনা পানির বৃক্ষও তো কম সৌন্দর্য বিলায় না। সাগরে এসেছি, পা ভেজাব না, তা কি হয়? পা ভেজালাম, গর্জনও শুনলাম।
এবার ফেরার পালা। রওনা দিলাম ফেনী রেলস্টেশনের দিকে। ফিরতি ট্রেন সন্ধ্যা সাতটার পূর্বে পৌঁছাবে। এদিকে আমাদের অলসতা আর সময়ের মূল্য না দেওয়ার কারণে ট্রেন প্রায় মিস হওয়ার পথে। টান টান উত্তেজনা। এতগুলো মানুষের দীর্ঘশ্বাস। সবকিছু মিলিয়ে এ যেন যুদ্ধের ময়দানে আমরা। বিজয় খুব কাছে তবু যেন তীরে এসে তরি ডুবল এমন ভাব। মহিপাল আসার আগেই একবার আকাশ সবাইকে নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ল দ্রুত স্টেশনে যাবে বলে। পরে দেখল রাস্তা ভুল। ভাগ্যের পরিহাসে যে বাস থেকে নেমেছিলাম, সে বাসেই আবার চড়লাম। জয় বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে যুক্তি করে কীভাবে দ্রুত স্টেশনে পৌঁছানো যায়, সে বুদ্ধি আঁটল। অবশেষে সফল আমরা। ট্রেন পেলাম। নাভিশ্বাস কমল। এ যাত্রায় সময়ের হেলাফেলা করা যাবে না, শিক্ষাটাও গ্রহণ করলাম। ট্রেন ছুটে চলছে। আমাদের এক দিনের ভ্রমণেরও সমাপ্তি ঘটছে।
সভাপতি, চাঁদপুর বন্ধুসভা