অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সার্থক সৃষ্টি ‘সংশপ্তক’

শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক বইয়ের প্রচ্ছদ

খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস ‘সংশপ্তক’। সংশপ্তক শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘হয় জয়, না হয় মৃত্যু’। শাব্দিক অর্থ করলে দাঁড়ায়—নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যে বীর মৃত্যুর আগপর্যন্ত লড়ে যায়। রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত এ দেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত জীবন নিয়ে এবং অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সার্থক সৃষ্টি ‘সংশপ্তক’।

জীবনের বড় একটি সময় শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন কারাগারের নির্জন গহিন প্রকোষ্ঠে। ‘সংশপ্তক’ রচনা করেছিলেন বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৬৪ সালে রচিত এবং ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে, শেষ হয় পাকিস্তান আমলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ–পরবর্তীকালীন দুর্ভিক্ষ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, মুক্তিসংগ্রামসহ সমাজের নানাবিধ অসংগতির প্রেক্ষাপটে বাকুলিয়া ও তালতলি নামে দুটি গ্রামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় কাহিনি।

উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে বাকুলিয়ার সৈয়দ পরিবার ও লুপ্তপ্রায় জমিদারির মিঞা পরিবার। সৈয়দ পরিবারে দুই ছেলে। বড়জন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। ইংরেজদের অধীন সরকারি চাকরিজীবী। ছোট সৈয়দ প্রাচীরপন্থী সুফি ধারায় বিশ্বাসী।

বড় সৈয়দের মেজ ছেলে জাহেদ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। উপন্যাসের নায়ক চরিত্র। কলকাতা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। জাহেদ প্রথমে পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। মুসলমানদের অধিকার আদায়ে, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সচেতনতা তৈরি করতে ঐক্যের আন্দোলন করেন। পাকিস্তান বিভাগের পর বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

ছোট সৈয়দের একমাত্র মেয়ে রাবেয়া আক্তার। ডাকনাম রাবু। রাবু উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। ছোট সৈয়দ তাঁর বৃদ্ধ পীর মুজাদ্দেদীর সঙ্গে রাবুর বিয়ে দেন। এতে জাহেদ তাঁর চাচা ও বৃদ্ধ পীরের ওপর হামলা করেন। হামলায় দরবেশ চাচা ও পীর পালিয়ে যায়।

উপন্যাসের কাহিনির অন্যাংশে আছে জাহেদের ছোট মামা ফেলু মিঞা। মিঞা বাড়ির জমিদারি লুপ্তপ্রায়। ফেলু মিঞার নায়েব রমজান। উপন্যাসের প্রধান খলনায়ক। ফেলু মিঞা তাঁর নায়েব রমজানের যোগসাজশে হারানো জমিদারি ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করেন। রামদয়ালের কাছ থেকে জমি ফেরত পেতে গরিব প্রজাদের ওপর নিপীড়ন চালান। এতে প্রজারা ফেলু মিঞা ও রমজানের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। নির্যাতিতরা অনেকেই ভিটাছাড়া, কেউ গ্রামছাড়া হয়।

মিঞা বাড়ির কাজের মেয়ে সুন্দরী যুবতী হুরমতি। হুরমতি ফেলু মিঞা ও রমজানের কামনার শিকার হয়। হুরমতি ফেলু মিঞার ঔরসজাত অবৈধ সন্তান প্রসব করে। নিজেকে রক্ষা করতে ফেলু মিঞা রমজানের সহায়তায় গ্রাম পঞ্চায়েত বসান। বিচারে হুরমতিকে পাপের শাস্তিস্বরূপ কপালে তামার পয়সার ছেঁকা দেওয়া হয়। ঘটনার কিছুদিন পর হুরমতির সঙ্গে কামনা চরিত্রার্থে গেলে হুরমতির দায়ের কোপে রমজানের একটি কান কেটে যায়। সেই রমজান হয়ে যায় কানকাটা রমজান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রমজান নারী পাচার ও কালোবাজারি করে প্রচুর টাকাপয়সার মালিক হয়। পরবর্তী সময়ে নায়েব রমজান হয়ে মিঞা বাড়ির পরিবর্তিত মিঞা তথা জমিদার। পরিবর্তিত নাম হয় কাজী মোহাম্মদ রমজান। লজ্জায় ও ঘৃণায় ফেলু মিঞা সবকিছু বিক্রি করে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন।

নায়িকা রাবু। সে বিবাহিতা, অতীতকে অস্বীকার করে বিপ্লবী জাহেদের সঙ্গে সমাজসেবায় ব্রত হয়। কলকাতা গিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে স্বনির্ভর করে। চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধে আশ্রয়শিবিরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। জাহেদকে সে ভালোবাসে। জাহেদের রাজনৈতিক স্বাধিকার আন্দোলনের সারথি রাবু।

উপন্যাসটিতে ছোট–বড় পঞ্চাশটি চরিত্র রূপায়ণ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রধান চরিত্রের মধ্যে আরও আছে মালু ও সেকান্দর মাস্টার। সেকান্দর মাস্টারের চরিত্রটি ব্যতিক্রমী। তিনি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের একজন নিবেদিত কর্মী। শুরু থেকেই মীমাংসিত এবং ঔপন্যাসিকের জীবনবোধের আদর্শ রূপ হিসেবে উপস্থাপিত একটি সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় বিশ্বাসী চরিত্র। তাঁর জীবন উপলব্ধি, আদর্শ, কর্মতৎপরতায় অনন্য।

ঔপন্যাসিক কাহিনির দ্বিতীয় পর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কলকাতার পটভূমিতে মালুর চোখ দিয়ে পরিবর্তনটা দেখায়। মালু প্রথমে মেসে রান্নার কাজ পেলেও পরে সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কলকাতায় মালু ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।

উপন্যাসের শেষ হয় জাহেদ গ্রেপ্তারের মাধ্যমে। বাম রাজনীতিতে জড়িত থাকায় অনেক পালিয়ে বেড়ান। অবশেষে নিজ গ্রামের বাড়িতে গ্রেপ্তার হন। তাঁর ফেরার প্রতীক্ষায় থাকেন রাবু। জাহেদ একজন দেশপ্রেমী বিপ্লবী। চরম বিপদের সময়েও তাঁর বিপ্লবী সত্তার প্রকাশ ঘটেছে।

সংশপ্তকের নাম সার্থকতা মূলত জাহেদ, রাবু, মালু, সেকান্দর মাস্টার, লেকু, কসির, হুরমতিদের  জীবনসংগ্রামের মাধ্যমে পাওয়া যায়। ‘সংশপ্তক’ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক মুক্তিসংগ্রামের এক অনবদ্য উপাখ্যান। আমাদের জীবনযুদ্ধে সংশপ্তক হওয়ার অনুপ্রেরণা জাগায়, সংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত করে।

একনজরে
বই: সংশপ্তক
লেখক: শহীদুল্লা কায়সার
ধরন: উপন্যাস
প্রকাশক: জোনাকী প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ১৯৬৫
মূল্য: ৩৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৪০০

সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা