শৈশবে বাবার শাসনের চোখ দুটো ছিল ভয়ের কারণ। মনে হতো বাবারা এত বাজে কেন হয়? একদিন স্কুলে যেতে না চাইলে, খেলার মাঠ থেকে দেরি করে ফিরলে দেখতে হতো বাবার রুদ্রমূর্তি! যৌবনের প্রারম্ভে ওনাকে মনে হতো রূপকথার দৈত্য। আমার রঙিন উর্বশী মনে, কলি থেকে ফুল হয়ে ফুটবার মুহূর্তে, উচাটন মনে কোনো কিছুকে পরোয়া না করার দিনগুলোতে, অতিরিক্ত কিছু করতে গিয়ে সর্বদাই রিক্ত হয়ে ফিরতে হতো বাবার কড়া শাসনে।
বাবাকে এতটাই ভয় পেতাম যে মনে হতো বাবা না থাকলেই বোধ হয় ভালো ছিল। বাবা আমায় একটুও ভালোবাসে না। মানুষের বাবারা কত ভালো হয়, কত আদরে তাদের পাশে থাকেন, তাদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে বসে থাকেন।
বাবাকে কখনোই আমি আমার প্রাপ্তিতে বগল বাজিয়ে নাচতে দেখিনি, কখনোই আমার অসুখে দুচোখ বেয়ে জলের স্রোত নামাতে দেখিনি। শত সহস্র আক্ষেপ নিয়ে বাবাকে সব সময় দেখেছি কড়া শাসনের চোখ দিয়ে আমাকে, আমাদের বেঁধে রাখতে। দেখেছি স্বার্থপরের মতো নিজের কাজ, নামাজ-রোজা ইবাদত নিয়ে ব্যস্ত থাকতে।
বাবার কোনো ভাই ছিল না। দাদা মারা গিয়েছিলেন ওনার শৈশবেই। অনাদরে বেড়ে ওঠা বাবা হয়তো তাই জানত না কীভাবে স্নেহে প্রেমে বেঁধে রাখতে হয়! সত্যি এমনই মনে হতো ওনাকে।
তিনি কোনো দিন আমাকে স্কুলে নিয়ে যাননি, কোনো দিন স্কুল থেকে নিয়ে আসেননি; যেমনটা আমি আমার সন্তানকে নিয়ে যাই, নিয়ে আসি।
একসময় মনে হতো বাবাকে খুব বেশি প্রয়োজন নেই জীবনে! সেই কঠিন, রাগী, মেজাজি বাবাকেও আমি কাঁদতে দেখেছি, নোনাজলে ভাসাতে দেখেছি চিবুক ও বুক। বড় ভাই যেদিন দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি দিলেন, সেদিন আমি ও বাবা ভাইকে বিদায় জানাতে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে!
ভাইকে বিদায় দিয়ে যখন ফিরছি বাড়ির দিকে, হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা একটি গাড়ির হেড লাইটের আলোয় বাবার মুখটা দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠলাম।
যে বাবাকে কোনো দিন আমি কিংবা আমাদের জন্য স্নেহে-প্রেমে আবেগপ্রবণ হতে দেখিনি, দেখতে পেলাম তাঁর চোখ বেয়ে নোনাজল সাদা পাঞ্জাবি ভেদ করে বুকটাকেও ভিজে ভাসিয়ে দিয়েছে। ওনার কাঁধে হাত রাখতেই শিশুর মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কাঁদলেন তিনি। এই কান্না আমার এত দিনের ভ্রান্ত ধারণাকে এক ধাক্কায় মাটিতে নামিয়ে দেয়।
সেদিনই প্রথম শাসনের আড়ালে বাবার চোখে জল দেখেছি। বুঝতে পেরেছিলাম বাবাদের সব ভালোবাসা সাদা চোখে দেখা যায় না। তারপর কিছুটা জানার চেষ্টা করি। জানতে গিয়ে জেনেছি বাবার সমস্ত জেদ, রাগ সব আমাদের ভালোর জন্য ছিল। জেনেছি প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে প্রার্থনায় ওনার দুই হাত উঠত আমাদের মঙ্গল কামনায়। জেনেছি আমাদের আরও ভালো জীবন না দিতে পারার আক্ষেপে ওনার চোখ জলে ভরে উঠত বেদনায়।
আজ বাবা নেই। প্রতি সেকেন্ডে ওনার অনুপস্থিতি টের পাই। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবাটাকে অনুভব করে কান্নায় ভেঙে পড়ি, বুকের গভীর থেকে উচ্চারিত হয় আমার বাবার মতো আদর্শবান বাবা যেন আমি অন্তত হয়ে উঠতে পারি।
সভাপতি, কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা