প্রিয় সুদীপ্ত,
তোমাকে লিখব বলে কত আকাশ–পাতাল ভাবি। কিন্তু সাহস জোগাতে পারি না। পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে সংকোচের পাহাড়। মৌনতায় কাটে আমার অষ্টপ্রহর। তবু লিখি তোমাকে। ডায়েরির পাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিদিনই চিঠি লিখি। গোপনে অশ্রুভেজা পৃষ্ঠায় নিজেকে মেলে ধরি।
জানো সুদীপ্ত, সেই কিশোরীবেলা থেকেই বুকের গহিনে পরম প্রেমে লালন করেছিলাম একটি স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের নাম ‘দাম্পত্য’। তখন মনে হতো দাম্পত্য হলো বিশাল এক বটবৃক্ষের ছায়া! শত খুনসুটিতেও একে অপরকে ভালোবাসার নিখাদ বাঁধনে জড়িয়ে রাখার অদ্ভুত এক মায়া। অতঃপর দাম্পত্যের বন্ধনেই দুজন মিলে খুলেছিলাম যৌবনের তালাবদ্ধ কপাট। পেয়েছিলাম প্রেমের নিখিলে বাধাহীন উড়ে বেড়ানোর কাঙ্ক্ষিত মুক্তির স্বাদ। ভালোবাসার পবিত্রতায় উন্মাতাল জলেশ্বরে জলতরঙ্গের ছন্দে বাঁধভাঙা কামনার উচ্ছলতায় স্বাধীনভাবে দুজন সাঁতার কেটেছিলাম, ভেঙেছিলাম পারস্পরিক সব আড়ষ্টতার বাঁধ।
মনে পড়ে সুদীপ্ত? আমরা ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পর তুমি কত যে ভালোবাসতে আমাকে। তখন সমস্ত কিছুই কিশোরীবেলার স্বপ্নের মতোই লাগত। দাম্পত্যের সুখের নদী কলকল বয়ে যেত আমার অন্তরে–বাইরে। পাগল করা প্রেম, কামনায় সিক্ত সোহাগ, আরও কত–কী! তখন চারপাশটা ছিল ভালোবাসার বকুল সুবাসে সুগন্ধিত। সুখের রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াত সমস্ত ঘরে। অথচ কিছুদিন যেতে না যেতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ তুমি বদলে গেলে। ব্যস্ততার খোলসে নিজেকে গুটিয়ে নিলে। এদিকে তোমাকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণায় ভেতরে–ভেতরে দগ্ধ হই আর একটু একটু করে বুঝতে পারি তোমার ব্যস্ততা নামের বাহানাকে। আসলে নীরবে এতকাল ধরে আমার সঙ্গে তুমি করেছ নিপুণ ছলনা। এখন সুখের দাম্পত্যের গহিনে ছায়া ফেলেছে বিষধর অবিশ্বাস। নিবিড় প্রেম ও আস্থায় সিক্ত আমার হৃদয় এখন ঘুণপোকার দখলে। বিষাদের জমাটবাঁধা নীলে কেবলই আটকা পড়ে সুখতৃপ্তির নিশ্বাস। হৃৎপিণ্ডের গহিনে অহর্নিশই নির্গত হয় আগ্নেয়গিরির লাভা। পুড়ে পুড়ে ক্ষত হয় বুকের জমিন। অবচেতনেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে গনগনে দীর্ঘশ্বাস!
জানো সুদীপ্ত, আজ কাছে থেকেও তুমি যেন অনেক দূরে! পাশে থেকেও তুমি সঙ্গে নেই। তোমাকে ছুঁয়ে বসে থাকলেও তোমার মুখটা বড্ড ঝাপসা দেখায়, অচেনা লাগে। আমার ভীষণ কষ্ট হয়, তোমার জন্য পরানটা পোড়ে। মাঝেমধ্যে তোমাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয়। ইচ্ছা করে চলে যাই দূর অজানায় সব বন্ধন ছিঁড়ে। কিন্তু ভালোবাসার শিকড়গুলো বুকের গভীরে এতটাই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়েছে যে তা টেনে উপড়ে ফেলতে চাইলে নিজেই কষ্ট পাই। তাই হাসির আড়ালে বিষাদ ঢেকে, তোমার অবহেলা আর তাচ্ছিল্য সয়ে যাই।
ভুলগুলো শুধরে একদিন নীড় হারানো পাখির মতো তুমিও হয়তো ফিরে আসবে অনুশোচনায়। মৌনতার ছকে বাঁধা এক জীবন্ত লাশ হয়ে আমি বেঁচে আছি শুধু তোমারই প্রতীক্ষায়...।
ইতি
তোমার প্রেমপিয়াসী সুপ্রভা
সেক্টর ১৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০