লেবুগন্ধমাখা বাড়াভাত

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

কলাপাতায় মিছামিছি বাড়াভাতের দিনগুলোতেও হাস্যরসের কমতি ছিল না। নানু দুপুরের খাবার পাতে তোলার আগে আরেক পর্ব চায়ের আয়োজন সেরে নিতেন। পাশের বাড়ির তসলিম নানা পেছনবাড়ির বেলিগেটে উঁকি দিয়ে নানুকে ডাকলেন, ‘বাউজ, দুপুরে ভাতের আগে‍ এক কাপ চা খাব, পরানটা খাঁ খাঁ করছে, টোস্ট বিস্কুট দিলে দিবেন, না দিলে নাই।’ অমনি মাটির চুলার কাছে মোড়া পেতে নানা বসলেন। নানু চা ঢাললেন বড় মগের মধ্যে। গরুর দুধের চা। আর নানুর শাশুড়ি থেকে পাওয়া ঐতিহাসিক কাচের বয়াম থেকে চা–চামচের কয়েক চামচ চিনি। সঙ্গে গ্লুকোজ আর মচমচে টোস্ট বিস্কুট। পাশের বাড়ির পরি নানু ততক্ষণে কাঁচা কাঁঠালের তরতরা নিয়ে পান খেতে খেতে হাজির।

‘বুজান, চা খাওয়ার জন্যই আইছি। আপনের হাতের চা খাইলে কইলজাটা জুড়াইয়া যায়!’ দুলেনা নানুও পাকঘরে উঁকি দিলেন। চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে বিস্কুট চুবাতে চুবাতে একগাল হাসি দিয়ে বললেন, ‘আগে এক কাপ চা খাইয়া লই।’ চায়ের তৃষ্ণা মনে মেখেই মেজ খালা জলের ঘাটে হলুদস্নান শেষে উঠানে মেলে দিলেন পাটের শাড়ি। চুল শুকাতে শুকাতে চুকচুক করে খাচ্ছেন দুপুরের চা। সমীর ঘটক চা খাওয়ার জন্য রোজই আসে। ভালো লাগার মানুষটিও আশপাশেই ঘুরঘুর করছে। চায়ের সঙ্গে ঢাকঢোল–বাদ্যবাজনা বেজে উঠবে নিশ্চয়ই। গাঢ় ঘন লিকার, গত রাতের সর পড়া ঘন দুধ আর আধচামচ চিনি। গল্পকথার পানসি নদী বারবার জানান দিচ্ছে জীবন আশ্চর্য সুন্দর! বিস্ময়করও।

হীরামতি নানু, চা খেতে খেতে সবাইকে আমসত্ত্ব বিলাচ্ছেন। কথায় কথায় কত কথা! পুববাড়ির রোশনী শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ভাইদের বাড়িতে আশ্রয় নিল। শেষ পর্যন্ত ভাই–ভাবি অপমান, মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিল। কখনো চায়ের চুমুকেও নেমে আসে ভয়ংকর নিস্তব্ধতা। চম্পাবতী নানু সুর তুললেন। বুকের কোনো এক গহিন জায়গায় সজোরে ধাক্কা খেলাম। চা–টুকু পেয়ালায় বিস্কুটসমেত হাবুডুবু খাচ্ছে। আর চুমুক দেওয়া হলো না।

অ্যারিজোনার ট্যাম্পে শহরে ধনাঢ্য এক পরিবারে জীবনের মারপ্যাঁচে ভাইদের খাঁচায় বন্দী জীবন্মৃত এক বোনের সঙ্গে ঘটনাটি মেলাতে পারলাম। জানালার পর্দা এলোমেলো দুলছে। টুপটাপ ঝরে পড়ছে কিছু ম্যাপলপাতা। চায়ের কাপে দুধের সর এঁকে ফেলছে দুর্বোধ্য এক মানচিত্র। ঠিক ব্যবচ্ছেদ করা যায় না। বাইরবাড়িতে এক কাপ চায়ের সঙ্গে লীলা বৈষ্ণবীর সুর, ‘তুই বড় আদুরি ছিলি রে!’

নানু চায়ের পেয়ালা একে একে তাকে গুছিয়ে রেখেছেন। ভরদুপুরের সোনা রোদ গায়ে মেখে কাগজি লেবুর মাখামাখিতে নতুন বাড়াভাতের আয়োজনও করে ফেলেছেন। ফুলকরা দস্তরখানা চমক ছড়াচ্ছে। আদুরে পৌষী এক লাফে কোলে! চায়ের কেটলি আবারও চুলায়। জম্পেশ আড্ডা হবে নিশ্চয়ই!

বেঁচে থাকার জন্য এক কাপ চা, একটু খড়কুটো, এতটুকু স্নেহ আর কাঁঠালপাতায় উঁকিঝুঁকি দেওয়া মিঠাই রোদ্দুরে লেবুগন্ধমাখা নতুন বাড়াভাতই যথেষ্ট!

ঢাকা, বাংলাদেশ