তিস্তা নদীর কৃষক

তিস্তা নদীর দুর্গম চর থেকে ধান ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়িতে আনছেন কৃষক। মর্নেয়া, গঙ্গাচড়া, রংপুরছবি: মঈনুল ইসলাম

শীত যায় যায় ভাব। শেষ বিকেলের সূর্যটা পশ্চিমে হেলে ডিমের কুসুমের মতো লাল হতে থাকে। মিষ্টিকুমড়ার খেতে ঘুরে ঘুরে পোকা খায় ক্ষুধার্ত একঝাঁক সাদা বক। সারা দিন তারা আধার খেতে পারেনি। খেতজুড়ে কিষান ছিল কয়েকজন। অবাঞ্ছিত আগাছা পরিষ্কার করেছে দিনভর। আসরের আজানের আগে হাতের কাস্তের ছায়া মেপেছে তারা। ছায়ার দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ হওয়ায় বুঝে যায় আসরের ওয়াক্ত কাছেই। সঙ্গে সঙ্গে খেত ছেড়ে চলে গেছে। কাজে ব্যস্ত কেবল মনছুর উদ্দীন। কুমড়াগাছে পানি দিচ্ছে, আশপাশে কেউ নেই। যত দূর চোখ যায় ধু ধু ফসলের খেত। অবশ্য এগুলো স্বাভাবিক কৃষিজমি নয়; তিস্তা নদীর বালুচর।

আজ থেকে ৩০, ৪০ কিংবা ৫০ বছর আগে এই তিস্তা নদীর ব্যাপক গভীরতা ছিল। সারা বছর পানি থাকত নদীতে। নাব্যতা ছিল। হরেক রকমের মাছ ছিল। নদীর বুক চিড়ে চলত নৌকা, বজরা, ট্রলার। মনছুর উদ্দীনের বাবার নৌকা ও বজরা—দুটোই ছিল। নদীতে মাছ ধরত আর সেই মাছ এই উলিপুর থেকে নিয়ে কখনো রংপুরে, কখনো গাইবান্ধার বালাসী ঘাটে গিয়ে বিক্রি করত। মাঝেমধ্যে নদীর ধারে বসে, গালে হাত দিয়ে মনছুর সেই সোনালি অতীতের গল্প করে তার জওয়ান ছেলেদের সঙ্গে। শূন্যে হারায় দৃষ্টি। আনমনে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে হৃদয়ের গহিন থেকে। পাশে বসা দুই ছেলেকে বলে, ‘মোর বাপের ২০-২৫ জন কামলা আছিল। নদীতে কী রে মাছ! সেই মাছ ধরি ধরি সওদা করছিলাম হামরা। বাপে বছরে কামলার দরমাই দিছিল ১০-১২ হাজার ট্যাহা! সেই দিনগুলা এলা কটে গেল! এলা তোমার বাপের কিচ্ছু নাইরে, বাপ। সোইগ নদীত গ্যাছে! এলা সেই নদীও গ্যাছে! হ্যাসকারি করেন না; খাটো, খাটো, নাইলে কী করি খাইবেন রে বাপ!’

মনছুর উদ্দীনের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় চেহারা। চুলে পাক ধরে; ভাঁজ পড়ে চামড়ায়। ঠিক তেমনই বদলে যেতে থাকে তিস্তা নদীর চেহারা। প্রতিবছর উজান থেকে আসা পাহাড়ি পানির ঢলে বালু আসে, পাথর আসে, আসে পলিও। ধীরে ধীরে নদীর বুকে এসবের আস্তর জমে। নাব্যতা হারায় নদী। পরিণত হয় এক মরা খালে। সেই মরা খালের বিশাল, বিস্তৃত বালুচরে পলির মিশ্রণের কারণে এখন ফসল ফলায় মানুষ। ভুট্টা, কাউন, মিষ্টিকুমড়া, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, বাদাম, বেগুন, পুঁইশাক, লাউ—হরেক রকমের রবি শস্য চাষের ধুম পড়ে নদীর শুকনা বুকে।

গ্রামে দিনমজুরের নিদারুণ অভাব। আজকাল বেশির ভাগই ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে। কেউ গার্মেন্টসে কাজ করে, কেউবা রিকশা চালায়। গ্রামে হাতে গোনা যে দু-চারজন রয়ে গেছে, তাদের মজুরি অনেক। ৫০০-৬০০ টাকা। এই টাকাই মনছুর উদ্দীনের জন্য অনেক। মাঝেমধ্যে দিনমজুর নিলেও অধিকাংশ সময় নিজেই কাজ করে। সঙ্গে থাকে তার মাধ্যমিক ফেল দুই ছেলে রাজু ও সাজু। আজ একটা ছেলেও সঙ্গে নেই। আধা বেলা বাবার সঙ্গে কাজ করে হাটে গিয়েছে রাজু। আর সাজু বাড়িতে নেই। সে হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে কোনো বাঁশঝাড়ে গিয়ে খেলতে বসেছে। জুয়া খেলার বড় নেশা তার।

গোধূলির শেষে সন্ধ্যা নামে। চিলের মতো ডানা মেলে নেমে আসে আঁধার। গাছে গাছে পানি দেওয়া শেষ হলো না তবু! চরম খিটখিটে মেজাজে সন্ধ্যার পরে হাতে বালতি-গামলা নিয়ে বাড়ি ফেরে মনছুর উদ্দীন। বাইরে থাকতেই উচ্চস্বরে বউকে বলতে থাকে, ‘রাজু হাট থাকি আসে নাই এলাও? একলায় একলায় এতগুলা গাছে পানি দেওয়া যায়? ফরুয়্যাটা কোণ্ঠে? আজ ফর খেলেই থাকবে। উয়ার ভাত বন্ধ করি দিবু আইজ!’
বউ আমতা আমতা গলায় বলে, ‘না, আসে নাই রাজু। আসবে আর। বইসো, জুড়ান তোমরা, খেত থাকি আইলেন, মাথা গরম করেন না।’ ছোট ছেলে দোষী। তাই কী আর করার। শান্ত করার চেষ্টা করে স্বামীকে। তাকে গামছা এনে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে দৌড়ায় সে। ভাত পোড়ার গন্ধ পেয়ে পাশের ঘর থেকে ‘মা, মা!’ বলে হাঁক ছাড়ে তাদের উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া মেয়ে। মেয়ের পরীক্ষা পরশু, পড়তে বসেছে। এ অবস্থায় কেমনে আর মাকে সাহায্য করে রান্নাঘরে।

ময়লা দেহ পরিষ্কার করে মনছুর উদ্দীনের খেতে বসার পালা এখন। এমন সময় বাইরে থেকে আওয়াজ আসে, ‘চাচা, বাড়িত আছেন বাহে?’ মনছুর উদ্দীন বুঝতে পারে নজির ব্যাপারীর কণ্ঠ এটা।

‘আছি বা, আইসো, আইসো।’ দুজনে বারান্দায় বসতে বসতে একে অপরের খোঁজখবর নেয়। মনছুর উদ্দীনের পেটে ক্ষুধা। নজির ব্যাপারীকেও ভাত খাইতে বলে সে। ‘না বাহে, ভাত না খাই। মাথা গরম। ব্যবসার হালচাল ভালো নোয়ায়। ট্যাহা বুলি আসছি, দিবার পাইবেন দুই একের ভিতরে?’ ‘আর কয়টা দিন ধৈর্য ধরো বাহে, ফসলগুলা তুলি; এবার দেমো তোমার সৌইগ ট্যাহা।’

মানতে চায় না নজির ব্যাপারী। তার সুদে-আসলে টাকা ফেরত চাই; যত জলদি সম্ভব তত ভালো। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো উপায় না থাকায় আমতা আমতা স্বরে একই বিষয় বুঝিয়ে চলে মনছুর উদ্দীন। নজির ব্যাপারী দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তার কাছ থেকে দুই দাগে ৭০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল সুদের ওপর। সেই টাকা এখন লাখের বেশি হয়ে গেছে। পরিশোধ করতে পারেনি। প্রথমবার টাকা ধার নেয় আমন ধান চাষের জন্য। প্রায় ১০ বিঘা জমি আবাদ করেছিল। বর্ষা মৌসুমের টানা বৃষ্টি আর উজানের পানি এসে সব ডুবিয়ে দিয়েছে। কিছুই থাকেনি বাকি। রয়ে গেছে শুধু একবুক হাহাকার।

আর দ্বিতীয়বারের দেনায় তালখেত, মিষ্টিকুমড়া, মরিচ ও ভুট্টার আবাদ করেছে। কয়েকবার চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে গিয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বীজ, সার প্রভৃতি সরকারি যে সাহায্য আসে তা যেন তাকে কিছু দেয়; কিন্তু লাভ হয়নি। যে সাহায্য পেয়েছে তা খুবই নগণ্য। চাষাবাদ করার জন্য অগত্যা দেনা করতেই হলো। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছে মনছুর উদ্দীন। সব ধারদেনা পরিশোধ করে দেবে। মেয়ের বিয়ের খরচও হয়ে যাবে। সে আশায় বেঁধেছে বুক।

অনেক অনুনয়-বিনয় করে বিদায় জানায় নজির ব্যাপারীকে। বড় ছেলে এখনো আসে না বাজার থেকে। মেয়েকে ডেকে নিয়ে খেতে বসে মনছুর উদ্দীন। রোজ তার খাওয়ার সময় হলেই চলে যায় বিদ্যুৎ। একদম অকারণেই; আজও ব্যতিক্রম হলো না। কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ভাত খায় তারা। মেয়ে, স্ত্রী আর সে। একটা ঘুঘুরে পোকা বারবার লাফ দেয় কুপির মাথা বরাবর। খেয়াল করে না কেউই। পোকাটা কয়েকবার লাফিয়ে হঠাৎ নিভিয়ে ফেলে কুপির আলো। কোনোমতে আবার কুপি জ্বালিয়ে খাওয়া শেষ করতে না করতেই দেখে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকছে বড় ছেলে রাজু।

‘কী হয়েছে রে, বাপ? এত দেরি হইল ক্যান?’ জিজ্ঞেস করে মনছুর উদ্দীন।
ছেলের ভেজা চোখ। কীভাবে বলবে বাবাকে, কী ঘটেছে। একটু চুপ থেকে মাথা নিচু করে বলে, ‘একটা ভ্যাজাল হইছে, আব্বা। সাজুকে পুলিশ ধরি নিয়ে গেছে!’
বাবার মন। একবার স্ত্রীকে গালি দেয়। আরেকবার গালি দেয় জুয়ায় আসক্ত ছেলেকে। গালি দিতে দিতে দৌড়ায়; অন্ধকার ভেদ করে দৌড়ায় নজির ব্যাপারীর বাড়ির দিকে। এই রাতেই টাকা দরকার। ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।

প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ ও উপদেষ্টা, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা