দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে

‘আগু‌নের পরশম‌ণি’র শুটিংয়ে হুমায়ূন আহমেদছবি: সংগৃহীত

ছেলেবেলায় আমার ঘুড়ি ওড়ানোর শখ ছিল। স্কুল ছুটির দিনগুলোতে ঘুড়ি হাতে পুরো মাঠ দৌড়ে বেড়াতাম। পাখির মতো নিজের বানানো ঘুড়ি আকাশের বুকে উড়তে দেখে ভীষণ আনন্দ লাগত।
সেবার রৌদ্রের প্রখরতা ও বৃষ্টির নিনাদ গায়ে মেখে ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হই। চিকিৎসক, বৈদ্য, কবিরাজ কোনো কিছুতেই জ্বর আমাকে ছাড়ে না। শেষে চিকিৎসক নিশ্চিত হলেন আমার জন্ডিস হয়েছে। তবে মারাত্মক কিছু নয়, সম্পূর্ণ বিশ্রাম ও বিধিসম্মত খাবার গ্রহণ করলে দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠব। মা অত্যন্ত চিন্তিত, বাবার কপালে চিন্তারেখার ছাপ।

জন্ডিসের দিনগুলোর অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। সারা দিন কেবল শুয়ে থাকা, হলুদবিহীন ঝোল-তরকারি খাওয়া, বৈদ্যমশাইয়ের পথ্য-পাতার রস, চিকিৎসকের ওষুধ। সব মিলিয়ে জীবন একদম তেজপাতা। বাবা ঘুড়ি আর নাটাই পাড়ার ছেলেদের দিয়ে দেন। তখন খেলার জন্য কিছুই ছিল না আমার, শুধু একটা ক্যারম বোর্ড ছাড়া। বন্ধুরা কেউ ধারেকাছে আসত না, ওদের মা–বাবা নিষেধ করেছিলেন। নিজে নিজেই ক্যারম বোর্ডের গুটিগুলো নাড়াচাড়া করতাম। কখনো বোন আমাকে সঙ্গ দিত, মা–বাবাও যুক্ত হতেন।

এমনই একদিন বিকেলে, উঠানে একটি ঘুড়ি এসে পড়ল। রঙিন কাগজের লেজওয়ালা সাপঘুড়ি। মাকে লুকিয়ে আলতো পায়ে হেঁটে ঘুড়িটা নিয়ে এলাম আমি। ঘুড়িটা সাদা কাগজের তৈরি, তার ওপর রংবেরঙের কলমে মুক্তার দানার মতো স্পষ্ট অক্ষরে বড় করে লেখা, ‘পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অপূর্ব অলৌকিক সংগীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়?’ প্রথম আঞ্চলিক হিমু উৎসব, আয়োজনে: পাঠক সোসাইটি।’

আজ হলে হয়তো কথামালাটি আমাকে ভাবনায় ফেলত। ইহজাগতিক ও পারমার্থিক বিষয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা করতাম। কিন্তু সেদিন আশ্চর্য হয়েছিলাম ‘হিমু’ ও ‘হিমু উৎসব’ সম্পর্কে জেনে। আমার প্রতিবেশী এক দিদি সে সময় পাঠক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ঘুড়ির লেখাটা দেখে কৌতূহলবশত মায়ের ফোন থেকে ওকে কল করি। জানতে চাই, হিমু, হিমু উৎসব কী, কেন, কীভাবে? আমার আগ্রহ ও আবদারে দিদি ওর সংগ্রহে থাকা হিমু সিরিজের ‘ময়ূরাক্ষী’ ও ‘দরজার ওপাশে’ বই দুটি পরদিন আমাকে দিয়ে যান। অসুস্থ থাকলেও শুয়েবসে পড়ায় আপত্তি ছিল না চিকিৎসকের। মা–বাবা আর আপত্তি করলেন না। আমি এক নিশ্বাসে ‘ময়ূরাক্ষী’ পড়ে ফেললাম।
বয়সের কারণে, না প্রকৃতির ধর্মে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। সেদিন ‘ময়ূরাক্ষী’ পড়তে পড়তে রূপা চরিত্র যতই উন্মোচিত হচ্ছিল, ক্লাসের একটি মেয়ের মুখ ততই আমার চোখে ফুটে উঠছিল। আমি ভাবছিলাম, রূপার মতো সে–ও কি একদিন আমার জন্য যত্ন করে শাড়ি পরবে? চুল বাঁধবে, ছাদে এসে দাঁড়াবে আমার অপেক্ষায়? সেদিন আমি মোটেই হিমুর মতো করব না। ওকে গুরুত্ব দেব, মাথায় তুলে রাখব। ছেলেবেলার ডায়েরিতে লেখা এসব কথা যখন পড়ি, বিষম ভালো লাগা কাজ করে। আমি ওই মেয়ের ফেসবুকের ওয়ালে চোখ বুলাই। রংবেরঙের শাড়ি পরে বিভিন্ন স্টাইলে তোলা ছবি ও শেয়ার করে ফেসবুকে। আমার ওকে রূপার মতো মনে হয়। আমি মাঝেমধ্যে লাভ রিয়েক্ট দিয়ে কমেন্ট করি, কখনো রূপা লিখি। ও কিছু বুঝতে পারে না। নাকি বুঝেও বোঝে না, তা বলতে পারি না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, হিমু হওয়াটাই ভালো। পৃথিবীতে যত্ন করলে কেউ যত্নের কদর করতে পারে না। আমরা তাকেই ভালোবাসি যে আমাদের ভালোবাসে না।

আমি সাহিত্যের বই পড়া আরম্ভ করি ‘ময়ূরাক্ষী’ ও ‘দরজার ওপাশে’ বই দুটি পাঠের মধ্য দিয়েই। স্কুলে থাকতেই পড়া হয়ে যায় অ্যান্টিলজিক ও লজিকের হিমু ও মিসির আলী সিরিজের সব বই। ‘রূপা’, ‘নবনী’ ও ‘বহুব্রীহি’র মতো হুমায়ূন আহমেদের আরও কয়েকটি পাঠকপ্রিয় উপন্যাসও পড়েছি। কলেজজীবনের শুরুতেই ‘তেঁতুল বনে জোছনা’ বই পড়ি। উপন্যাসের নায়ক চিকিৎসক আনিসকে লেখা নবনীর চিঠিটা পড়ে আমি বেশ কিছু সময় স্তব্ধ ছিলাম। বুক নোট ডায়েরিতে চিঠির কয়েকটি কথা নোট করা আছে। আমি প্রায়ই বুক নোট ডায়েরিটা পড়ি। নবনী আনিসকে লিখেছেন, ‘আনন্দকে তীব্র করার জন্য কষ্টের প্রয়োজন আছে। তা–ই না?... ডাক্তার সাহেব, তুমি আমার জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলেছ—তার প্রতিদানে আমি “জনম জনম কাঁদিব”।’ কী নিটোল সত্য কথা। ভীষণ কষ্টের পরের আনন্দ তীব্র হয়ে ওঠে। জীবনে কেউ কারও জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। আমার জন্য কেউ কি কোনো দিন দুফোঁটা চোখের জল ফেলবে?

কথায় আছে, বড় গাছ জানান দিয়েই বড় হয়। হুমায়ূন আহমেদ যে বটবৃক্ষ, তার প্রমাণ নিয়েই পাঠক মহলে হাজির হলেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। বহুল জনপ্রিয় এই উপন্যাস যখন পড়ি, তখন আমি সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্র। ‘নন্দিত নরকে’ ভীষণভাবে আন্দোলিত করল আমাকে। মানুষের ভেতরের মানুষকে নিয়ে চিন্তা করার শক্তি পেল মস্তিষ্ক। আমি ‘হ্যাঁ’ মানুষ ও ‘না’ মানুষ সম্পর্কে ভাবতে শুরু করলাম। স্কুলপড়ুয়া কয়েকজনের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বললাম, ‘হুমায়ূন আহমেদের কবিতা পড়েছ কে কে?’ ওরা আশ্চর্য হলো। উত্তরে প্রত্যেকের এককথা, ‘উনি কবিতা লিখেছেন, জানি না তো।’ এমন কিছু শুনব, প্রত্যাশা করেছিলাম। তাই মন খারাপ হলো না আমার। আসলে কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্যের এতটা জুড়ে আছেন যে তাঁর লেখা কবিতা পাঠকের আড়ালেই রয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের আশ্চর্য চোখের কৌতূহল আরও একটু বাড়িয়ে দিতে কবি হুমায়ূনের ‘গৃহত্যাগী জোছনা’ কবিতার শেষ অংশটি চোখ বন্ধ করে পড়ে শোনালাম।
‘আমি সিদ্ধার্থের মতো/ গৃহত্যাগী জোছনার জন্য বসে আছি।/ যে জোছনা দেখামাত্র/ গৃহের সমস্ত/ দরজা খুলে যাবে।/ ঘরের ভেতর/ ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব, আর হাঁটব।/ পূর্ণিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে,/ চারিদিক থেকে বিবিধ কণ্ঠ/ ডাকবে…আয়, আয়, আয়।’

শিল্পীমাত্র স্বাধীনচেতা হন, শিল্প–সাহিত্য, এমনকি জীবনের অনেক তুচ্ছ বিষয়েও আপস করেন না, মানিয়ে নেন না। আত্মস্বাতন্ত্র্যবোধ ও শিল্পের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে মহাকবি মাইকেল থেকে হুমায়ূন আহমেদ প্রত্যেকেই আকাশের মতো বিশাল। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি কাল্পনিক চরিত্রকে বাঁচানোর জন্য আন্দোলন হতে পারে, দেয়াললিখন হতে পারে—এমন চিন্তা করাও বিরল ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে। ‘নাটক’ জীবনের কথা বলে। বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ জীবনের বাস্তব ছবিকে নাটকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসির প্রতিবাদে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল। পথে নেমে এসেছিলেন দর্শক। দাবি একটাই, বাকের ভাইকে ফাঁসি দেওয়া চলবে না। দেয়াললিখন হয়েছিল, ‘বাকের ভাইয়ের মুক্তি চাই’। চিঠির মাধ্যমে ও ফোনে হুমায়ূন আহমেদকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল যেন বাকের ভাইকে ফাঁসি না দেওয়া হয়। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু হুমায়ূন মেনে নেননি, দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, যেভাবে লেখা সেভাবেই হবে। ভাবনাচিন্তার কিছু নেই। স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছিল। নাট্যকার জনপ্রিয়তা, দর্শক–চাহিদা, হুমকি, প্রশস্তি তথা অনুরোধের কাছে পরাজিত হননি।
‘আমার যমুনার জল দেখতে কালো,
চান করিতে লাগে ভালো,
যৌবনও মিশিয়া গেল জলে’
এমন অসাধারণ মিষ্টি কথা ও সুরের মিশ্রণে হুমায়ূন আহমেদ বাঙালির জন্য রেখে গেছেন ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র মতো অনবদ্য সব সিনেমা। বোধ করি হুমায়ূন আহমেদ দর্শক হৃদয়ের স্বাদ অনুভব করতে পেরেছিলেন। যুগযুগান্তরে বাঙালির কাছে এসব নাটক-সিনেমা কখনো পুরোনো হবে না। সব প্রজন্ম ভালোবেসে আগ্রহের সঙ্গে উপভোগ করবে। শুধু কি তা–ই, হুমায়ূন আহমেদ আবিষ্কার করেছেন অভিনয়জগতের কয়েকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রকে। যাঁদের অভিনয় আমাদের মুগ্ধ করে। আমরা আনন্দিত হই, অনুভব করতে পারি শিল্পের সার্থকতা কত মধুর, আনন্দপূর্ণ।

গান মনের কথা বলে। গানে সব দুঃখ ভেসে যায়; গানেই বলে দেওয়া যায়, কী প্রয়োজন আর কী প্রয়োজন নয়। কাকে ভালোবাসি বা কাকে ভালোবাসি না। একজন অসাধারণ মানুষ, শিল্পী সব ক্ষেত্রে সমান আলো ছড়াতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদ এই অসাধারণত্ব নিয়েই পৃথিবীতে এসেছিলেন। সাহিত্য, চলচ্চিত্র যেখানেই স্পর্শ করেছেন, সেখানেই ফলেছে সোনার ফসল। তাঁর লেখা গল্প অত্যন্ত আনন্দদায়ক। তাঁর ভাবনার আকাশ পৃথিবীর মতো বিশাল। ‘সবুজ বরন লাউডগায় দুধ সাদা ফুল ধরে’ অন্তরের চোখ ছাড়া সাধারণ চোখের দৃষ্টিতে এ নিটোল সৌন্দর্য অনুভব করা যায় না। বলা যায় না, ‘চাঁদনি পসরে কে আমায় স্মরণ করে, কে আইসা দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে।’ একমাত্র হুমায়ূন আহমেদই বলতে পারেন, ‘ও আমার উড়ালপঙ্খী রে/ যা যা তুই উড়াল দিয়া যা/ আমি থাকব মাটির ঘরে/ আমার চক্ষে বৃষ্টি পড়ে/ তোর হইবে মেঘের উপরে বাসা’।
বইবিমুখ একটি প্রজন্মকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কলমের জাদুতে বইয়ের পাতায় টেনে এনেছিলেন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল, বড় হয়ে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমি বড় হওয়ার অনেক আগেই মানুষটি না–ফেরার দেশে চলে গেছেন।

সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা যশোর