রাত ৮টা থেকে ৮টা ৩০–এর মধ্যে গাড়ি ঢাকায় পৌঁছাবে। অফিস ছুটির কাছাকাছি সময়। বৃহস্পতিবার। বড়সড় জ্যামে পড়ার শঙ্কা। বসে বসে ভাবছি। হঠাৎ কাউন্টারের দেয়াল ঘড়িটা ডং করে উঠল। চারটা বাজে। গাড়ি ছাড়বে। সিঙ্গেল চেয়ারে সিট, সি-১। এসি বাস। মাথার ওপর ঠান্ডা বাতাস ঝরে পড়ছে। সুপারভাইজার ভদ্রলোক একটা জলের বোতল হাতে দিয়ে বললেন, ‘যাত্রা শুভ হোক।’ ব্যাপারটা ভালো লাগল। কিছু দূর যেতেই গাড়ি থামল। যাত্রী উঠবেন। আমার পাশের ডাবল চেয়ারের একটি সিট ফাঁকা। তার পাশের জানালার ধারের সিটে বসেছেন মধ্য বয়সের একজন লোক। তিনি ঘুমাচ্ছেন। মোবাইল বেজে উঠল। বাবার ফোন। গাড়িতে উঠেছি জানানো হয়নি। মিনিট দুই কথা হলো। এর মধ্যে কয়েকজন যাত্রী উঠলেন গাড়িতে। তাঁদের একজন ডাবল চেয়ারের ফাঁকা সিটটিতে বসলেন। ভদ্র তরুণী, ২০ কি ২১ বছর বয়স হবে। পরনে সাদা সালোয়ার–কামিজ। চোখে রিমলেস চশমা। ঠোঁটে হালকা বেগুনি রঙের লিপস্টিক। চুলগুলো খোপা করে বাঁধা। অপরূপ প্রতিমার মতো দেখতে। নির্নিমেষ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছি। সহযাত্রীদের কেউ কেউ তিক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ব্যাপারটা পরিমাপ করার চেষ্টা করছেন। তাই ইচ্ছে না করলেও মনের পরে পাথর চাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করতে হলো। ঘুম ভাঙল সুপারভাইজারের ডাকে। গাড়ি তখন কাড়ারগাতী, গোপালগঞ্জ সদরে। দশ মিনিটের যাত্রাবিরতিতে সবাই নিচে নেমেছেন। আমাকেও নিচে নেমে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিতে বললেন।
একে একে গাড়ির ভেতরের বাহারি আলোগুলো জ্বলে উঠল। ভদ্র তরুণীর দিকে চেয়ে আছি। একটা বই বের করে কোলের ওপর রেখে ওড়নার এক অংশ দিয়ে চশমার কাচ মুছে নিলেন তিনি। চোখ টেনে টেনে বইয়ের নামটা পড়ার চেষ্টা করছি। ‘১০০ প্রেমের কবিতা’ মহাদেব সাহা। বইটা আমি পড়েছি। কাব্যগ্রন্থটিতে ‘তোমাকে ছাড়া’ শিরোনামের একটা কবিতা আছে। কবিতাটা খুব পছন্দের। আমি পছন্দের কবিতা মুখস্ত করি।
ছাবিরা রউফ ফিলিং স্টেশন বড় একটি জায়গা নিয়ে। নিচে নামতেই চোখ গেল ক্যাফের দিকে। ফিলিং স্টেশনটির মাঝামাঝি অংশে ‘ক্যাফে হাইওয়ে’। ভদ্র তরুণী কফি খাচ্ছেন। খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও পাশাপাশি দাঁড়াতে পারব ভেবে ভেতরে গেলাম। আমার পছন্দের ফাস্টফুড, ড্যানিশ। সঙ্গে কফিও নিলাম। ‘ড্যানিশ’ পৃষ্ঠ হওয়ার কড়মড় শব্দ শুনে তরুণী হাসলেন। আনন্দের হাসি। বন্ধু কাব্য, থাকলে ভালো হতো। হাসির সূত্র ধরে কথা শুরু করতে পারত। আমার সে যোগ্যতা নেই। মেয়েদের বুঝতে পারি না আমি। স্রেফ বন্ধুত্বের দাবিতেও কখনো কারও সঙ্গে কথা হয়নি, কথা হয় না। যার দিকে এগোই, যাকে পছন্দ করি, ভালো লাগে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। মানুষটিরও নিশ্চয়ই আপন মানুষ আছে। আর থাকলেই বা কি, আমি তো আর ভালোবাসতে যাচ্ছি না। রাস্তার ভালোলাগা রাস্তাতেই ফুরিয়ে যাবে! ভেবে বিষণ্ন মনে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
দশ মিনিটের যাত্রাবিরতি হলেও গাড়ি ছাড়ল বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট পর। তখন সন্ধ্যা হব হব প্রায়। একে একে গাড়ির ভেতরের বাহারি আলোগুলো জ্বলে উঠল। ভদ্র তরুণীর দিকে চেয়ে আছি। একটা বই বের করে কোলের ওপর রেখে ওড়নার এক অংশ দিয়ে চশমার কাচ মুছে নিলেন তিনি। চোখ টেনে টেনে বইয়ের নামটা পড়ার চেষ্টা করছি। ‘১০০ প্রেমের কবিতা’ মহাদেব সাহা। বইটা আমি পড়েছি। কাব্যগ্রন্থটিতে ‘তোমাকে ছাড়া’ শিরোনামের একটা কবিতা আছে। কবিতাটা খুব পছন্দের। আমি পছন্দের কবিতা মুখস্ত করি। আমার স্মরণশক্তি ভালো, মনে থাকে। কয়েক লাইন মনে মনে আওড়ালাম।
‘এই ঢাকা শহর ভীষণ রুক্ষ মনে হয়
কাউকে ডাকলে সাড়া দেয় না, সবাই আমার বিরুদ্ধাচরণ করে
তুমি না থাকলে এই বাড়িঘর শহরের লোকজন
সম্পূর্ণ আমার অপরিচিত মনে হয়।’
সুগভীর বেদনায় বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠল।
রাত ৮টা ১৫ বাজে। গাড়ি ঢাকায় ঢুকল। সিগনাল নাকি জ্যাম, বোঝা যাচ্ছে না, গাড়ির পর গাড়ি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার আত্মীয়-স্বজন ঢাকাতে যাঁরা আছেন, সবাই শহর থেকে দূরে থাকেন। আমাকে থাকতে হবে হোটেলে। তেমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু বড় ভাই শাকিব হাসান নিষেধ করলেন। বললেন, থাকার ব্যবস্থা করেছেন। হোটেলে উঠতে হবে না। তাই আমি যাব তাঁর অফিসে। কিন্তু প্রচুর জ্যাম, গাড়ি এক মিনিট এগোই তো দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। গুলিস্তান পর্যন্ত পৌঁছতেই এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগল। কারও কারও কাছে নয়টা ত্রিশ, রাত মনে না হলেও অচেনা শহরে আমার কাছে অনেক রাত। আমি চিন্তিত, কপাল ঘামে ভিজে জবজবে। ঠিকমতো কিছু চিনি না। আগে কোনোদিন নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে ঢাকা আসিনি। ঠিকভাবে শাকিব ভাইয়ের কাছে পৌঁছতে পারব তো! ফাঁকা রাস্তায় একা পেয়ে মোবাইল, মানিব্যাগ সঙ্গের সব মন্দ লোকেরা যদি কেড়ে নেয়? কিংবা মোবাইল, টাকা-পয়সা দিতে না চাওয়ায় মাথায় বাড়ি দিয়ে মাথা ফাঁটিয়ে দেয়। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবার রক্ত জল করা টাকায় চলে সংসার। পড়া শেষ হলেই কাজে ঢুকে যাব। ইত্যাদি ভাবনার কষাঘাতে দুই চোখ জলে টলমল। সুপারভাইজার সাহেব তাকিয়ে আছেন দেখে টান টান স্বরে কারওয়ান বাজার কীভাবে যাব, জিজ্ঞেস করলাম। ভদ্রলোক কথা খরচ করার আগেই পাশ থেকে ভদ্র তরুণী বললেন, ‘আমিও কারওয়ান বাজার যাব। আমার সঙ্গে যেয়েন।’ ঐশ্বরিক আর্শীবাদের মতো প্রশান্তিতে সমস্ত চিন্তা জল হয়ে গেল। গুলিস্তান থেকে বাসে উঠলাম। ভদ্র তরুণী পাশে বসলেন। চুল থেকে শ্যাম্পুর গন্ধ ভেসে আসছে। পারফিউমের গন্ধটাও সুন্দর। তরুণীর পাশে বসার অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম। আগে কখনো বসিনি। বসার সুযোগ হলেও এড়িয়ে গেছি। লোকাল বাসের সিটগুলো ছোট। অসৎ চরিত্রের পুরুষেরা সুযোগটা নেয়। মেয়েদের, মায়েদের অসম্মান করে। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কিছু না হলেও ভদ্রতা, নৈতিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা শিখেছি। যথেষ্ট আঁটসাঁট হয়ে এক পা সিটের বাইরে রেখে বসলাম। কয়েক মুহূর্ত যেতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কারওয়ান বাজার কোথায় যাবেন?’
—প্রথম আলোর অফিসে।
—পরিচিত কেউ চাকরি করেন, না কোনো কাজে এসেছেন?
—পাঠক সংগঠন, বন্ধুসভা করি। কাল সংগঠনের আয়োজনে ‘লেখক বন্ধু উৎসব’। ওই আয়োজনে যোগ দিতে এসেছি।
—পোস্টার দেখলাম ফেসবুকে। বই বেরিয়েছে?
স্মিত হাসি হেসে মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম।
—দশজনকে তো মনে হয় পুরস্কারও দেবে, তাই না!
মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম।
—দেখবেন, আপনি পুরস্কার পাবেন। আপনার চেহারায় সাহিত্যিকের গন্ধ আছে। লেগে থাকলে ভালো করবেন।
মুহূর্তে ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ মুভির একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ল। মহেন্দ্র সিং ধোনির ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের ঘটনা। একের পর এক ম্যাচ খারাপ খেলছেন। পরের ম্যাচে সুযোগ পাবেন কি পাবেন না, নিশ্চিত নন। দলের সঙ্গে ফ্লাইটে করে যাচ্ছেন। পাশের সিটে বসেছেন একজন তরুণী। তিনি শচীন টেন্ডুলকারের ভক্ত। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অটোগ্রাফ নিতে পারেননি। ধোনির গায়ে টিমের জার্সি দেখে বললেন, ‘একটা অটোগ্রাফ এনে দিন না, প্লিজ।’ ধোনি শচীনের অটোগ্রাফ এনে দিলেন। তারপর দুজনের মধ্যে নানা কথা হলো। সময় খারাপ যাচ্ছে ইত্যাদি বললেন ধোনি। সব শুনে তরুণী হাসতে হাসতে বললেন, আগামী ম্যাচ হবে আপনার জীবনের গ্রেট ম্যাচ। ধোনি হাসলেন। আর হাসতে হাসতেই বললেন, গ্রেট ম্যাচ হলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করবে। তখন কী করব! তরুণী হাসি ছড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলেন।
ঘটনার পরম্পরায় কিনা জানি না, মনের ভেতর ভিজিটিং কার্ড ভিজিটিং কার্ড আর্তনাদ হলেও মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। গাড়ি কারওয়ান বাজার পৌঁছলে কনডাকটর নামার তাগাদা দিলেন। নিচে নেমে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন তিনি। চোখে চোখ পড়তেই হাসি ছড়িয়ে বললেন, ‘রাস্তা পেরিয়ে সামনে গেলেই প্রথম আলো। অনেক শুভেচ্ছা রইল আপনার জন্য।’ গলা দিয়ে সামান্য ধন্যবাদ শব্দটাও বেরোল না। তিনি সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলেন। কিছু সময় চেয়ে রইলাম। একবারও পেছন ফিরলেন না। অদমনীয় বেদনায় বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। ছ্যাৎময় যন্ত্রণা বুকে নিয়েই বন্ধুসভা কক্ষে গেলাম। শরীর ক্লান্ত, কণ্ঠে জড়তা, মন উচাটন। তারপরও শাকিব ভাই, তাহসিন ভাই কাউকে কিছু আঁচ করতে দেব না ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করলাম। অফিসে যেতেই শাকিব ভাই, তাহসিন ভাইয়ের যত্নে মনের ব্যথা কিছুটা কমল। কিন্তু শাকিব ভাই খাওয়ার অফার করলে না করলাম। মন খারাপ থাকলে আমার খিদে পায় না, খেতে পারি না। তাহসিন ভাই বাসায় ফেরার পথে গন্তব্যে নামিয়ে দিলেন আমাকে। রাতে ভালো ঘুম হলো না। গানের সুরের মতো মাথার ভেতর কেবল তরুণীর কথায় ঘুরতে লাগল।
সকালে উঠে লম্বা শাওয়ার নিলাম। মন খারাপ থাকলে জীবনের নানা দুঃখের স্মৃতি মনে পড়ে। যত দ্রুত সম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে। ছয়টা ত্রিশ বাজে। যাদের অমোঘ আতিথেয়তায় কালকের রাতটা কেটেছে। তাঁরা সবাই ঘুমাচ্ছেন। চেনে না জানে না, এমন একটা মানুষকে কেউ যে এতটা যত্ন করতে পারে! শাকিব ভাই, আলাদিন আল আসাদ ভাইয়ের বাসায় থাকার ব্যবস্থা না করলে জানা হতো না। আমাকে বিছানায় ঘুমাতে দিয়ে ফ্লোরে ঘুমিয়েছিলেন মানুষটা। ডাকতে মায়া হচ্ছে ঘুম ভেঙে যাবে। তারপরও বেরিয়ে যাচ্ছি, বলে যাওয়া কর্তব্য। মাথার শিয়রে গিয়ে আস্তে করে ডেকে বললাম, ‘আসাদ ভাই, আমি বেরোলাম।’ তিনি থতমত খেয়ে উঠলেন। ‘চলে যাচ্ছেন। এত সকালে। অনুষ্ঠান শুরু হতে তো অনেক দেরি। চলেন আমিও যাই, আপনাকে রিকশা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’
রাস্তায় যেতে যেতে নানা কথা হলো। হঠাৎ আসাদ ভাই বললেন, ‘সামনেই সংসদ ভবন। চলেন, আপনারে দেখিয়ে নিয়ে আসি।’ সাইকেল আরোহীদের একটি গ্রুপ সংসদ ভবনের সামনে ফটোসেশন করছিল। তাদের দেখেই কিনা বলতে পারি না, আসাদ ভাই বললেন, ‘মোবাইল দেন। আপনার কয়টা ছবি তুলে দিই।’ পরপর বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন। হঠাৎ বড় রাস্তা পেরিয়ে আমার দৃষ্টি ছুটে গেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দিকে। সাদা সালোয়ার–কামিজ পরনের একজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ দেখা যাচ্ছে না। আমি দৌঁড়ে গেলাম। আসাদ ভাইও পিছুপিছু ছুটলেন। না, ভদ্র তরুণী নন। আহত হলাম। আসাদ ভাই রাগত স্বরে বললেন, ‘এমন কেউ করে। ভালো–মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে কী হতো!’ উত্তরে কিছু বললাম না। আমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আসাদ ভাই ফিরে গেলেন।
আমি পৌঁছলাম প্রথম আলো অফিসের বন্ধুসভা কক্ষে। কিছুটা সময় কাটল। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে প্রথম আলোর ১০তলায় সভাকক্ষে গেলাম। সকাল ১০টায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে লেখক বন্ধু উৎসবের পর্দা উঠল। কবিতা, গল্প, ফিচার, লেখালেখির নানা বিষয়ে আলোচনা করলেন কবি সাজ্জাদ শরিফ, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, শাহনাজ মুন্নী ও কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ। আলোচনা শেষে ২০২২-২৩ সালে বন্ধুসভা ওয়েবসাইট ও স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত লেখার মান বিচারে বর্ষসেরা সেরা দশ লেখকের নাম ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক শুরুতে শেষ থেকে পাঁচজনের নাম ঘোষণা করলেন। না, আমি নেই, আমার নাম নেই। হঠাৎ জেগে ওঠা আশাটি দপ করে নিভে যাওয়া আলোর শিখার মতো নিভে গেল। তরুণীর মুখচ্ছবি চোখের ভেতর জ্বলজ্বল করে উঠল। বিজয়ীরা সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করছেন। করতালির ছন্দে মুখরিত প্রথম আলোর সভাকক্ষ। চেয়ে চেয়ে দেখছি। জাফর সাদিক, মাইক্রোফোন থেকে মুখ সরিয়ে বাম হাতে থাকা কাগজে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এবার প্রথম থেকে পাঁচজনের নাম ঘোষণা করছি।’ সেরা লেখক হওয়া না হওয়া নিয়ে কখনো মাথাব্যাথা ছিল না, আজও নেই, ভবিষতেও কখনো হবে না। কারণ, আমি লিখি, না লিখে থাকতে পারি না বলে। পুরস্কার, সম্মান, খ্যাতির প্রতি কোনো লোভ নেই। সচেতন মনের ধারণা হলেও ওই মুহূর্তে কেন জানি না বারংবার ভদ্র তরুণীর বলা কথাগুলো মনে পড়তে লাগল। আমি অন্যমনস্ক। সাইফুল ভাইয়ের ডাকে স্বাভাবিক হলাম। ‘যান পুরস্কার নিয়ে আসেন, আপনাকে ডাকছে তো।’
প্রচণ্ড দাবদাহের পর অকৃত্রিম সন্দিগ্ধ বৃষ্টির মতো বুকের পরে, চোখের পরে তৃপ্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। সেরা দশের তালিকার প্রথম নামটি আমার। উৎফুল্ল চিত্তে হাসি মুখে সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়ার পর কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক স্যার পিঠ চাপড়ে দিলেন। শিক্ষকের পবিত্র স্পর্শে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা পেলাম। পাশ থেকে মৌ আপু, শাকিব ভাই বলতে লাগলেন, ‘ও নিয়মিত লেখে।’ আলতাফ ভাই ‘আলাদিনের গ্রামে’ কাব্যগ্রন্থে অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় শুভেচ্ছা বার্তায় লিখলেন, ‘কবিতার মতো জীবন হোক।’ বন্ধুসভার সভাপতি উত্তম রায় দাদা, বুকের ভেতর নিয়ে ছবি তুললেন। বললেন, ‘আসছিস, আর কবে আসবি, বাসা থেকে ঘুরে যা।’ শাকিব ভাই বিভূতির জনপ্রিয় উপন্যাস ‘আরণ্যক’ উপহার দিয়ে বললেন, ‘এমনই চমৎকার লিখতে হবে। লেখার স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখেন। আমাদের লেখক দরকার। না হলে পথ দেখাবে কে!’ এত এত বিশুদ্ধ আনন্দের মধ্যেও কেবল বাসের তরুণীর কথায় মনে পড়তে থাকল। আমি তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। ভাবনা আজও শেষ হয়নি, কোনোদিন হয়তো শেষ হবে না। কিছু মানুষ অদেখা মনের মতো। হুটহাট জীবনে এসেই হারিয়ে যায়। রেখে যায় এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।
কেশবপুর, যশোর