জমি-জিরাত

জমি থেকে আলু তুলে তা গৃহস্থের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষিশ্রমিকেরা। মীরগঞ্জ এলাকা, রংপুর। প্রতীকীছবি: মঈনুল ইসলাম
অনেকক্ষণ ধরে ঘেউ ঘেউ করতে থাকা কুকুরগুলো শান্ত না হওয়ায় প্রথমে সাহস করে ঘর থেকে বের হয় রফিক। এত রাতে কী হয়েছে, তা দেখার জন্য।

উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যায় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পিচঢালা রাস্তা। বিরান তেপান্তরে এসে হঠাৎ সেই রাস্তা থেকে পূর্ব দিকে নেমে গেছে আরেকটি রাস্তা। সাপের মতো এঁকেবেঁকে মাঝিপাড়া গ্রাম ভেদ করে থেমেছে গিয়ে তিস্তা নদীর তীরে, বাহাদুর ব্যাপারীর উঠানে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রাস্তা কয়েক বছর আগে নিজেদের উদ্যোগে পাকা করে নিয়েছে ব্যাপারীরা। কাঁচা, মোটা রাস্তায় মাঝিপাড়ার বাসিন্দাদের তেমন সমস্যা বোধ না হলেও ব্যাপারীদের সমস্যা হয়। কারণ, তাদের চার চাকার নানা ধরনের গাড়ি রয়েছে। বাহাদুর ব্যাপারীর পাঁচ ছেলের তিনজনই রংপুর শহরে থাকে। একজন চাকরিজীবী, বাকিরা ব্যবসায়ী। আর এখানে, গ্রামের এই বাড়িতে ব্যাপারীর বাকি ছেলেদেরও বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে কৃষিকাজের পাশাপাশি।

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যে এখনো একান্নবর্তী পরিবার দেশের কোথাও কোথাও টিকে আছে, তা বিস্ময়কর বটে। তেমনই একটা পরিবার বাহাদুর ব্যাপারীর। আশি ছুঁই ছুঁই এ বৃদ্ধ চলনে-বলনে, মনোবলে পঞ্চান্ন-ষাট বছরের কোনো ব্যক্তি যেন। হুঁক্কা টানার চল এ যুগে না থাকলেও সে এখনো হুক্কা টানে। দু-একটা দাঁত হয়তো পড়েছে; তবু এ বয়সে এসেও পান-সুপারি দাঁতেই চিবিয়ে খায় এবং অনবরত খায়। বুড়ো বাহাদুর ব্যাপারী শক্ত হাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে বহাল তবিয়তে টিকিয়ে রেখেছে তার পরিবারকে। বউ, ছেলেপুলে, নাতি-নাতনি, আয়া, খানসামা, আরদালি, পেয়াদা, চাপরাশিসহ সব মিলে তার পরিবারে খাওয়ার লোকের সংখ্যা ত্রিশের বেশি। সঙ্গে বেহিসাবি দু-চারজন তো আছেই।

ভাদ্র মাসের তালপাকা গরম নেমেছে গ্রামে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ আসে। দিনের চেয়ে রাতে যেন অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রচণ্ড গরম পড়ে। তবু সারা দিনের ক্লান্তির কারণে নাক ডেকে ঘুমায় রফিকের বউ। সারা দিন স্বামীর সঙ্গে তাকে কাজ করতে হয় ব্যাপারীদের ধানের চাতালে। তারপর বাড়িতে এসে কোনোমতে খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে একবার শুয়ে পড়তে পারলেই কেচ্ছা খতম। তখন বিদ্যুৎ এল না গেল, তাতে তার কিছুই আসে যায় না। সে ঘুমায় দেদার!

রফিকের ঘরটা মাঝিপাড়ার বুক চিরে চলা সেই রাস্তা ঘেঁষে। রাস্তায় ব্যাপারীদের মোটরসাইকেল, কার, ভটভটি, নসিমন চলে রাত-বিরাতে। কখনো কখনো বিকট শব্দে ছিন্নভিন্ন করে দেয় গ্রামীণ রাতের নীরবতা। সারা দিনের ক্লান্তি ছাড়া যদি স্বাভাবিক শরীরে ঘুমাতে যায় রফিকরা, তবে ঘুম যে সহজে আসে না বা থেকে থেকে ভেঙে ভেঙে যায়, তা সহজেই অনুমেয়।

ভোররাতের দিকে বিভিন্ন বাড়ির একসঙ্গে ঘোরাফেরা করা কয়েকটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকারে ঘুম ভাঙে স্বামী-স্ত্রীর। প্রথমে তারা ভেবেছিল, এই কালিসন্ধ্যার সময় হয়তো কোনো জিন-ভূত দেখে ঘেউ ঘেউ করছে কুকুরগুলো। গ্রামীণ চিরায়ত বিশ্বাস এই যে মানুষেরা জিন-ভূত দেখতে না পারলেও অবলা প্রাণী বা জন্তু-জানোয়ারেরা তাদের দেখতে পারে; তাই তারা চিৎকার-চেঁচামেচি করে। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ঘেউ ঘেউ করতে থাকা কুকুরগুলো শান্ত না হওয়ায় প্রথমে সাহস করে ঘর থেকে বের হয় রফিক। এত রাতে কী হয়েছে, তা দেখার জন্য। প্রচণ্ড অন্ধকার যেন বরফের মতো জমাট বেঁধে আছে চারদিকে। সেই বরফের সংস্পর্শে তার সাহসও চুপসে যায়। একা একা এগোতে একটু ভয় পায় সে। বউকে ডাকে। ঘুমে বিভোর বউ স্বামীর ডাকে একটু নাখোশ হয়। ‘উঠচোং...’ বলে ধীরে ধীরে উঠে টর্চলাইট জ্বালায় আর স্বগতোক্তি করে, ‘ঘাটাত কী হইছে, হইছে; নিন্দ্ পাড়া বাদ দিয়ে তাহো বলে মরাটাক দেখব্যার যাওয়া নাইগবে!’

রফিকের অনেক কিছু মনে পড়ে। বয়স তার চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। সে জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে ব্যাপারীদের বাড়িতে তারা কাজ করে দিনাতিপাত করে। আগে তার মা-বাপ করত, এখন সে করে। এভাবেই চলে আসছে।

রফিক কাশি দেওয়ার মতো গলায় শব্দ করে। বউ ‘ছেই, ছেই...’ করে টর্চলাইট মারতে মারতে রাস্তায় বেড়িয়ে দেখে, তাদের বাড়ির কালো কুকুরটা পড়ে আছে। বাকি কুকুরগুলো লেজ বাঁকিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পূর্ব দিকে মুখ করে ঘেউ ঘেউ করছে। পড়ে থাকা তাদের কুকুরটার নিথর দেহ থেকে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। একদম তাজা ও গরম রক্ত। রফিকের প্রচণ্ড খারাপ লাগে। মুখ থেকে কথা বের হয় না তার। যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে সে। কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, ব্যাপারীর বাড়ির কেউ মোটরসাইকেল বা গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটিয়েছে তারা । বেপরোয়াভাবে গাড়ি নিয়ে ছোটে তারা। ফলে চাকার তলে কারও ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগী কিংবা কুকুর-বিড়াল...কী পিষ্ট হলো, তা দেখার ফুরসত নেই তাদের। মানুষের কোনো অবুঝ শিশু হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ, মাঝিপাড়ার মূর্খ ও গরিব লোকজন কিছু বলবে না। একদিকে তারা ব্যাপারী পরিবারের ওপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে দুই-চার-পাঁচ হাজার টাকা হলেই মুখ বন্ধ হয়ে যায় তাদের। শোক পালিয়ে যায়, ভেসে যায় তিস্তা নদীর জলে!

‘কুত্ত্যা মইচ্ছে, তারে জন্নে তোমরা মোক তুলি আইনলেন!’ রফিকের বউ আধোস্বরে উদাসীন মনে বলতে থাকে। বাড়ির পোষা কুকুর হওয়ার কারণে একটু খারাপ লাগলেও সে উড়িয়ে দেয় তার অনুভূতি। ‘ইয়্যার আগোত হামার নচনচা একটা খাসিয়া মারি থুইয়া গেছে বড় ব্যাপারীর ছোট ব্যাটা, তা তো কিছু হয় নাই...আরও তো এলা কুত্তা!’ রফিক চুপ করে শুনে যায়। আরও দুই-একজন অন্ধকারে অদূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হইছে গো, কী হইছে অটে?’ কুকুরটার নিথর দেহ থেকে রক্ত ঝরা দেখে রফিক ঘাবড়ে গেছে। চুপসে গেছে। কথা ফুটছে না তার মুখে। ‘নোওয়ায় গো, নোওয়ায়! হামার কুত্ত্যাটা মইচ্ছে! কাঁই বেন ডলি থুয়া গেছে!’ জবাব দেয় রফিকের বউ। জবাব শুনে তারা আর এগিয়ে আসার দরকার বোধ করে না; দূর থেকেই যে যার মতো ফিরে যায়। ফিরে যায় রফিক ও তার বউও।

রফিকের দশ-বারো বছরের ছেলেটা কয়েক দিন ধরে বাড়িতে নেই। ভাগ্যিস সে তার নানার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। সে থাকলে কী যে একটা মাতম পড়ে যেত বাড়িতে! কুকুরটা তারই পোষা। সে-ই এটার যত্নআত্তি করে থাকে।

মাঝিপাড়ার বাসিন্দাদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী হলেও কেউ কেউ অন্যান্য পেশায়ও জড়িত। বিশেষ করে কৃষিকাজে। আর ইদানীং তিস্তা নদীতে পানিই থাকে মাত্র তিন-চার মাস। কাজেই যারা জেলে, তারাও বাকি সময়টা কৃষিকাজ করে পাড়ি দেয়। তাদের নিজেদের জমি-জিরাত যেহেতু নেই বললেই চলে, তাই তারা বাহাদুর ব্যাপারীর জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে। মাঝিপাড়ার উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম এমনকি পূর্বে যে তিস্তা নদীর বিস্তৃত বালুচর, সেখানেও অধিকাংশ জমিই বাহাদুর ব্যাপারীর। ফলে পাড়ার সবাই ‘বাদুচ্চা’ কিংবা ‘বাদুদ্দা’নির্ভর। গ্রামের লোকজন নানা কারণেই ‘বাহাদুর’কে ‘বাদুর’ বলে ডাকে। আপাতদৃষ্টে বাহাদুরের স্থলে বাদুর শব্দের উচ্চারণ সুবিধাজনক হলেও বাদুড়ের মতো বাহাদুর ব্যাপারীর ক্ষমতা বহুদূরব্যাপী বিস্তৃত হওয়ার একটা গুরুত্বও বহন করে হয়তো। কারণ, বাদুড় চোখ দিয়ে না দেখেও শুধু শব্দের ব্যবহার করে সারা বন-বাদাড়ে রাজত্ব করে, নির্বিঘ্ন উড়ে উড়ে।

রফিকের আর ঘুম আসে না। বউয়ের ঘুম আসতে চাইলেও রফিক কথা বলে ঘুম নষ্ট করে তার। রফিকের অনেক কিছু মনে পড়ে। বয়স তার চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। সে জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে ব্যাপারীদের বাড়িতে তারা কাজ করে দিনাতিপাত করে। আগে তার মা-বাপ করত, এখন সে করে। এভাবেই চলে আসছে। শুধু তারাই নয়, এই গ্রামের বেশির ভাগ লোকই ব্যাপারীদের কাজ করে। কেউ তাদের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে। কেউ তাদের তালখেতে রবিশস্য ফলায়। কেউ আবার তাদের চাতালে, কোল্ড স্টোরেজে কাজ করে। ফলে গ্রামের মাতব্বর থেকে শুরু করে নেড়িকুত্তাটা পর্যন্ত ‘বাদুচ্চা’ কিংবা ‘বাদুদ্দা’র বিরুদ্ধে টু শব্দ পর্যন্ত করে না। অর্থ-সম্পদ, আইন-আদালত, চেয়ারম্যান-মেম্বার সবই ব্যাপারীদের হাতের মুঠোয়। ফলে তাদের সঙ্গে বৃথা লাগতে গিয়ে নিজেদের পেটে লাথি মারাটা একদম আহাম্মকি বৈ কিছু নয়। একটা কুকুর, একটা ছাগল কিংবা একটা হাঁস মরলেও তারা চোখ বুজে সহ্য করেই আসছে।

ব্যাপারীদের বিরুদ্ধে কথা না বলার আরও একটা হেতু রয়েছে। তা হলো, বাদুর ব্যাপারীর সুনিপুণ চতুরতা। সে দীর্ঘদিন ধরে শুধু বুদ্ধির জোরে তার বিশাল পরিবার সামাল দিয়ে ধরে রেখেছে। গ্রামে প্রায় শ দুয়েক পরিবার রয়েছে। কারও সঙ্গে কারও মতের মিল নেই। কিন্তু প্রায় সবাইকেই সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে; অনেককেই হাতে রাখে বাদুর ব্যাপারী। ইদানীং অবশ্য অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে যায়, গার্মেন্টসে কাজ করে; রিকশা চালায়; তারা আর ব্যাপারীদের মানা তো দূরের কথা, তাদের কথাও শুনতে চায় না।

রফিকের আরও মনে পড়ে, ছোটবেলায় যখন সে অন্য ছেলেদের সঙ্গে স্কুলে যেতে চাইত, তার বাবা তাকে নিষেধ করতেন। বলতেন, ‘তিন মাইল দূরোত যায়া লেকাপড়া করি কী করবুরে বাপ! হামার সয়সম্পত্তি আছে? হামাক তো ব্যাপারীর বাড়িতই কাম করি খাওয়া লাইগবে রে বাপ!’ তবু স্কুলে যাওয়ার জন্য জেদ ধরত ছোট্ট রফিক। বাবা তখন বলতেন, ‘শুনছোং ব্যাপারী বলে একটা স্কুল করি দিবে গ্রামোত। সেইটা হলে অট্টে যাইস।’

আজ দেয়, কাল দেয় করে করে স্কুল একটা করে দিয়েছে ব্যাপারী গ্রামে; কিন্তু তত দিনে রফিকদের পড়াশোনা করার বয়স পেরিয়ে গেছে। এখন সেই স্কুলে পড়তে যায় রফিকদের বাচ্চারা। সেখানেও সমস্যা। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও জমিদাতা হিসেবে ব্যাপারী পরিবারের লোকজনই শিক্ষক ও কর্মচারীর চাকরি করে। স্কুলটি তাদের পৈতৃক সম্পত্তি হওয়ায় সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা নেই সেখানে। স্কুলের ক্লাস, ঘড়ি, ঘণ্টা সবই চলে তাদের মনমর্জিমতো! এসব বিষয় অবশ্য গ্রামের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী অতটা বুঝতেও পারে না; ফলে মাথাও ঘামায় না।

তবু মাথায় প্রশ্ন জাগে, ব্যাপারীর বাড়িতে ঝামেলা কিসের? ব্যাপারী না সুস্থ? কয়েক দিন আগেই রংপুরের হাসপাতাল থেকে এল!

দুই.
গল্প আর স্মৃতি রোমন্থনে সকাল হয়ে যায়। সূর্য ওঠে ধীরে ধীরে। হাঁস-মুরগি ডাকে। জীবনের কোলাহল শুরু হয়ে যায় ঘরে ঘরে। খাওয়াদাওয়া সেরে স্বামী-স্ত্রী রওনা হয় ব্যাপারীর বাড়িসংলগ্ন চাতালের দিকে। এমন সময় রাস্তায় দেখা হয় গ্রামের মাতব্বর হাসান মিয়ার ছেলের সঙ্গে। সে রফিককে বলে, ‘বাপে তোমাক এলায় ডাহাইল বাড়িত। এহ্না দেহা করি যাও।’

রফিকের মেজাজটা একটু বিগড়ে যায়। ‘কী হইল ফির অজগবি? দালালটা ডাহায় ক্যা মোক?’ বলে বউয়ের চোখে তাকায় রফিক। ‘ক্যা বেন ডাহায়! চলো, দ্যাহা করি যাই; নাহ্লে ফির খ্যাপি যাইবে দালালটা। কোন গঁয়দা বেন কী কানকথা লাগাইছে উয়াক,’ বলে বউ।

আসলে, মাতব্বর হাসান আলি ওরফে খুম্ন্যা হাসান ওরফে দালাল হাসানকে গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই ঘৃণার চোখে দেখে। কারণ, সে বাদুর ব্যাপারীর খাসদালাল। ব্যাপারীদের টাকাপয়সা খায়; তাদের জমি আবাদ করে খায়; ইউনিয়ন পরিষদসহ সরকারের বিভিন্ন দান-অনুদানের মালসামান ব্যাপারীর ছেলেদের তদবিরে তুলে তুলে খায়। আরও নানা কারণেই এলাকায় বাদুর ব্যাপারীর পেটোয়া লাঠিয়াল ও দালাল হিসেবে পরিচিত সে। লোকজন তার বিরুদ্ধে কথা বলে না। বলতেও চায় না। আসলে যেহেতু খুম্ন্যা হাসানকে মানুষজন ঘৃণা করে এবং তারা অশিক্ষিত ও শ্রমজীবী হওয়ায় নিজেদের পেট নিয়েই শশব্যস্ত থাকতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাই দালাল হাসানকে নিয়ে ভেবে তারা সময় নষ্ট করতে চায় না। এ জন্যই হাসান আলি কাউকে তলব করলে পারতপক্ষে তারা তাকে এড়িয়ে চলতেই বেশি আগ্রহ দেখায়।

মাতব্বর হাসান আলি আকারে বেঁটে। তাই লোকজন তাকে খুম্ন্যা হাসান বলে ডাকে। সব সময় তার মুখে পান ভরা থাকে। পানের কারণে ভারী জিহ্বায় আস্তে আস্তে কথা বলে সে। বাড়ির উঠানে তার দু-চারজন সাঙ্গপাঙ্গসহ বসে থেকে সে দেখে, রফিক আসছে তার বউসহ। রফিককে বসতে বলে গত রাতে তার নিহত কুকুরের প্রসঙ্গ তোলে। একপর্যায়ে রফিক বলে যে ব্যাপারীর বাড়ির কেউ জোরে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো তার কুকুরটাকে পিষ্ট করে চলে গেছে; তখনই চটে যায় খুম্ন্যা হাসান। ‘এ তুই দেখছিস, কাঁই তোর কুত্ত্যা মাইচ্চে? হাকাউ ব্যাপারীর বাড়ির মাইনষের দোষ দেইস!’
‘চাচা, কুত্ত্যার জন্নে তো মুই দাবি চাং নাই; তাও খালি তোমরা ওমার ফ্যারে টানেন! ইয়ার আগোত মোর খাসিয়াটাক যে দিনে-দুপুরে ব্যাপারীর নাতি মটরসাইকেল দিয়্যা মারি থুইয়া গেছিল, মুই কিছু কইছোং? দশ হাজার ট্যাহা দামের খাসিয়া মোর, আর তোমরা মোটে তিন হাজার ট্যাহা ডন্ডি নিয়ে দিছলেন!...মুই কিছু কইছোং?’ ইত্যাদি আমতা আমতা করে বলে রফিক। সে মাতব্বরের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে যেতে চায় না। কারণ, তার যে সাঙ্গপাঙ্গ অনেক, শুধু তা-ই নয়; সে যদি ব্যাপারীর বাড়িতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে, তাহলে হয়তো ব্যাপারীর চাতালে তার কাজ করা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। সে আশঙ্কায় বউও হাত ধরে টানে তাকে। ‘হোক, চলো তো! এইগ্ল্যা ভ্যাকুয়া ফ্যাদ্লা পাড়ি লাভ আছে? মইচ্ছে কুত্ত্যা মইচ্ছে...তার কী হইছে হামার!’

রফিক বউসহ পথ ধরে। ‘কুত্ত্যা নিয়ে চাতালোত যেন একটা টু-আও হয় না, কয়া দিনুং...এমনি ব্যাপারীর বাড়িত ঝামেলা চলবেন্নাগছে...’ খুম্ন্যা হাসানের শাসানি রফিকের পেছন পেছন দৌড়ে আসে। তিরের ফলার মতো কানে ঢোকে তার। নিহত কুকুরের লাল রক্তে এখনো রঞ্জিত তার ভাবনার জগৎ। তবু মাথায় প্রশ্ন জাগে, ব্যাপারীর বাড়িতে ঝামেলা কিসের? ব্যাপারী না সুস্থ? কয়েক দিন আগেই রংপুরের হাসপাতাল থেকে এল!

চাতালে সারা দিন কাজ করলেও ব্যাপারীর বাড়ির ভেতর শ্রমিকেরা যায় না বললেই চলে। যাওয়ার দরকারও হয় না। আর বড়লোকদের বড় বড় কারবার বলে কথা। দিনমজুর রফিকের তাদের বাড়ির ভেতর আসলে তেমন দরকার নেই। কালেভদ্রে যায়। শেষ কবে গিয়েছে তা-ও মালুম নেই। তাই ব্যাপারীর অন্দরমহলের খবর নেই তার কাছে। সে বউসহ চাতালের দিকে হাঁটে। মনে মনে উৎসাহ দানা বাঁধে, কী ঘটছে ব্যাপারীর বাড়ির ভেতর, তা জানার জন্য।

মৃত বাবার কাছে রফিক শুনেছিল, ব্যাপারীর এই প্রাসাদতুল্য বাড়ি ছিল এক হিন্দু জমিদারের। দেশভাগের সময় সেই জমিদার তার অর্ধেক সম্পত্তি এখানে রয়ে যাওয়া এক ছেলের জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করে দিয়েছিল। সে সময় বাদুর ব্যাপারীর বাপ করিম উদ্দিন চাকর বা চাপরাশির কাজ করত জমিদারবাড়িতে। জমিদারের ছেলের রহস্যজনক মৃত্যুর পর রাতারাতি কোনোভাবে সবকিছুর মালিক হয় যায় করিম উদ্দিন। পরে তার বার্ধক্যজনিত মৃত্যু হলে সবকিছুর মালিকানা চলে যায় ছেলে বাহাদুরের হাতে। বাহাদুর খুবই ধূর্ত প্রকৃতির আর আগ্রাসী মানসিকতার। জমি কেনা তার নেশা। জমিই তার ধ্যান-জ্ঞান। ছলে-বলে-কৌশলে সে তার জমি-জিরাত আরও বাড়ায়। কখনো নামমাত্র মূল্যে, কখনো সুকৌশলে, কখনো বা ঠকিয়ে। ফলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার কখনোই সুসম্পর্ক ছিল না। গ্রামের হতদরিদ্র বাসিন্দারাও বড়লোক বাহাদুর ওরফে বাদুর ব্যাপারীকে ভালো চোখে দেখে না। কেবল বিশাল ভূসম্পত্তির কারণে লোকদেখানো সমীহ করে চলে।

প্রতিবেশী তো দূরের কথা, নিজের মেয়ে যমুনা আর কল্পনার সঙ্গেই সম্পর্ক নেই বাদুর ব্যাপারীর! দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে বহু বছর হলো। বড় মেয়ে যমুনা স্বামী, ছেলেমেয়ে অর্থাৎ তার পরিবারের প্রয়োজনেই পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ চেয়েছিল; বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ব্যাপারী মাঝেমধ্যে ছোট মেয়ে কল্পনাকে বলত, ‘বড় ঘর দ্যাহি ব্যাচে খাইচোং তোমাক; যমুনার বিয়ের সময় ৩৭০ শতাংশ জমি লেখি দিছোং জামাইয়ের নামে। তাও উয়্যার আটেচাইরে খালি জমির বায়না!’ বাপের মুখে এমন কথা শুনে কল্পনা বাপের বাড়িতে আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে! ব্যাপারটা এমন যে সম্পর্ক যায় যাক, জমি যেন না যায়! জমির প্রতি বড্ড মায়া বুড়ো বাদুর ব্যাপারীর।

মাঝিপাড়ার প্রায় শ দুয়েক পরিবারের বলা চলে ইদানীংকার শিশুরা ছাড়া সবাই নিরক্ষর। হাতে গোনা দু-চারজন কোনোমতে শিক্ষিত হয়েছে, যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। তারা গ্রাম নিয়ে, গ্রামের অশিক্ষিত, দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে মাথা ঘামায় না। নানা কারণের মধ্যে অন্যতম হলো, তাদের মাথার ওপর চেপে আছে এক নব্য জমিদার। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে বহু আগেই; কিন্তু গ্রামের বাসিন্দারা কোনো না কোনোভাবে বাদুর ব্যাপারীর নব্য জমিদারির জাঁতাকলে পিষ্ট।

গ্রামের লোকজনের সঙ্গে ব্যাপারীদের স্বাভাবিক সংস্রব খুব একটা নেই। কুকুর পোষার মতো তারা মাতব্বর পোষে গ্রামে গ্রামে। সেই মাতব্বরদের মাধ্যমেই জমিজমা, বাজার-সওদাসহ সবকিছুরই বন্দোবস্ত হয়ে যায়। নিয়ন্ত্রিত হয় গ্রামের রাজনীতিও।

চাতালে গিয়ে রফিক কাজে নামার প্রস্তুতি নেয়। আজ সকালবেলায়ই চাতালে কাঠফাটা রোদ। সারাটা দিন যে কত উষ্ণ যাবে, আল্লাহ মালুম! চাতালে এক সহমজুরের এক জোড়া কুকুর মাঝেমধ্যে আসে। আজও এসে মালিকের পাশে বসে আছে কুকুর জোড়া। হঠাৎই বিভ্রমবশত নিজের কুকুর ভেবে চুক চুক করে কুকুরটাকে ডাকে রফিক। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, তার কুকুর তো নিহত হয়েছে। সহমজুর তাকে প্রশ্ন করে, ‘কী হইছে অফিক ভাই, চোকচোক কইরব্যান্নাগচেন ক্যা?’
‘না, এমনেই। হামার কুত্ত্যাটা আইতোত মরি গেছে রে...!’ রফিক কথা শেষ করতে না করতেই তার সহমজুর বলে ওঠে, ‘মানুষ মরি যাবান্নাইগছে এতি, আর তোমরা আছেন কুত্ত্যা নিয়্যা...!’
‘মানে? কাঁইল ফির মরিল? মুই তো কিছুই জানোং না রে...!’
সহমজুর বলে, ‘বাদুরদ্যা...!’
না, বাদুর ব্যাপারী মরেনি। সে যখন কিছুদিন আগে রংপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল, তখন তার রংপুরস্থ তিন ছেলে বাড়িতে আসে। তারা তাদের দুই বোন যমুনা ও কল্পনাকেও হাজির করে। যোগসাজশ করে তারা তাদের ভাগের প্রায় অর্ধেক জমি বাকি দুই ভাই ও পাশের গ্রামের চুন্নু ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করে দেয়। দলিল করার সময় বাপকে মৃত দেখায় তারা। এ ছাড়া তাদের কোনো গত্যান্তর ছিল না। তারা ব্যবসার ঋণ শোধ করবে; রংপুরে জমি কিনবে; বাড়ি করে সেখানে স্থায়ী হবে বলে বাপের কাছে তাদের জমির ভাগ চেয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু জমিপ্রেমিক বুড়ো বাহাদুর ব্যাপারী তার জমি হাতছাড়া করতে নারাজ।

একটু সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে আসে বুড়ো ব্যাপারী। জমি বিক্রির অতি গোপনীয় খবরটি গোপন থাকে না বেশিদিন। সে জানতে পারে শিগগিরই। তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে বারবার মূর্ছা যায় বুড়ো। সেদিন থেকেই অর্ধপাগল হয়ে একধরনের গৃহবন্দী সে।

সদর, কুড়িগ্রাম