মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাব অনেক দিন পর। উনি ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় যান। কিন্তু আমার যাওয়া হয় না। আমার স্কুল ছুটি থাকলে মার সময় হয় না, আবার মার ছুটি থাকলে আমার হোম টিচার, পড়া—সব মিলিয়ে সুযোগ আর হয়ে ওঠে না।
মা এবার পাঁচ দিন ছুটি নিয়েছেন। দাদার বাড়ি যাব। অনলাইন-অফলাইনে ক্লাস করতে করতে ভীষণ একঘেয়ে লাগছে। মূলত আমাকে সময় দেওয়ার জন্যই তিনি এবার ছুটি নিয়েছেন। ভেবেছিলাম এবার ট্রেনে যাওয়া হবে। কিন্তু এই পথে গেলে অটোতে করে অনেকটা পথ যেতে হয় বলে মা রাজি হলেন না। বাসেই যাব সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা।
রাতে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। আমাকে এ ব্যাপারে মায়ের সাহায্য করতে হয় না। যেসব মা চাকরি করেন, তাঁদের সন্তানেরা দ্রুত স্বাবলম্বী হতে শিখে যায়। নিজের কাজ নিজে করে করে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
পরদিন যথাসময়ে রওনা হই। গাজীপুর চৌরাস্তায় পৌঁছানোর পর বিপত্তি সৃষ্টি হলো। এক ঘণ্টা ধরে বাস এগোচ্ছে মন্থরগতিতে। প্রচণ্ড জ্যাম, প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা লাইন। মা ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে এসেছিলেন বলে রক্ষা। আমি ওয়েফার ভিজিয়ে চা খেলাম। হঠাৎ খারাপ লাগা শুরু হয়, যেকোনো মুহূর্তে বমি আসতে পারে। আশপাশে চোখ রাখলাম, ভালো কিছু দেখা যায় কি না। মনের পরিবর্তন জরুরি এই মুহূর্তে। কুয়াশার চাদর মাড়িয়ে একটু সূর্যের আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। দূরের গাছগুলো যেন হাসছে।
বিকেলের দিকে গ্রামের প্রবেশপথে পৌঁছালাম। আমাদের গ্রামটা ছবির মতন সুন্দর। চারদিকে বিশাল ফসলের মাঠ, মাঝখানে গ্রাম। তার পেছনে ফলের বাগান আর বাঁশঝাড়। তারপর আবারও মাঠ পেরিয়ে আর একটি গ্রাম। গ্রামগুলো গোছানো, ঠিক যেন শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা কোনো চিত্র। এক সারিতে দাঁড়িয়ে পুরোটা গ্রাম। আমি অনেক গ্রামে গিয়েছি, কিন্তু এটি সেরা আমার কাছে। বিকেলের রোদ কিছুটা আছে এখনো। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাঁস-মুরগি ঘরে ফিরছে। ছোট ফুপু ওদের খাবার দিচ্ছে আর ডাকছে, ‘আয়, তই তই। আয় তই তই।’
সামনের পুকুর থেকে ছোট চাচা মাছ ধরে আনল আমাদের জন্য। দিদা আমাকে সবগুলো ডালায় ঢেলে দেখাচ্ছে। মাছ নড়ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! দিদা চা আর গরম–গরম ভাপা পিঠা দিল খেতে। দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। গা ছমছম করছে ভয়ে। বারান্দায় বসে আছি, মা পাশে। মাটির চাড়ির ভেতরে আগুন জ্বলছে। সবাই সেটাকে ঘিরে গোল করে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কত কথা সবার!
দিদার সাহায্যকারী মেয়েটা ঢেঁকিতে পিঠার চাল গুঁড়ি করছে। আর গীত গাইছে। আঞ্চলিক ভাষায় গাইছে, আমি সব বুঝতে পারছি না। কিন্তু ভালো লাগছে। একটা উৎসব উৎসব আমেজ বাড়িময়। সকালে গরম–গরম পিঠা আবারও। গাছ থেকে কলা পাড়া হলো। বিকেলে কলাপিঠা বানানো হবে। এই আনন্দ নিজের ভেতর যে তোলপাড় তোলে, তা লিখে বোঝানো যায় না।
দিদার কাছে রাতে শুলাম। সে গল্প বলছে। ভূতের গল্প, কিন্তু বেশির ভাগ কথাই আমি বুঝতে পারছি না। তবু শুনতে ভীষণ ভালো লাগছে। পরদিন মার মামাবাড়ি যাব। দিদা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আরও থাকলাম না কেন? এই কষ্ট তাকে পীড়ন দিচ্ছে। আমার চোখেও পানি। আগে দিদা ঢাকায় গিয়ে অনেক দিন থাকত। কিন্তু এখন বয়স হওয়ায় যেতে পারে না।
আমার ভীষণ ইচ্ছা ছিল কোনো এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কথা বলব। তাঁকে ছুঁয়ে দেখব। মা আমার এই শখ পূরণের জন্য রওনা হলেন তাঁর মামার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। নানা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন যখন, তিনি ক্লাস নাইনে পড়েন। বজলু নানা মায়ের আপন মামা। কেন্দুয়া থেকে অটোতে করে কিশোরগঞ্জে পৌঁছাতে সময় লাগল দুই ঘণ্টা। নানা আমাদের দেখে ভীষণ খুশি।
শেষ পর্যন্ত আইবি আইবি কইরা আইলি তাইলে। আমি জোয়ান থাকতে তোর পোলারে লইয়া আইলি না। কান্দে লইয়া ঘুরতাম পারতাম।
মামা, আমার পোলা হাঁটতে পারে। তোমার কান্দে লওন লাগত না।
নাতি রারে কান্দে কইরা ঘুরাইনের মজা আছে বেডি, এইতা তুই বুঝতি না।
আমার নাতি আমারে দেখত চাইছে! এইডাই আমার কাছে মেলা খুশির। আমার খুব আনন্দ লাগতাছে রে বেডি। অহন তো কেউ আর আমরার খোঁজ নেয় না।
মামা, আমার ছেলেকে তোমার অনেক গল্প করেছি। ও তোমার মুখ থেকে শুনবে বলেই এসেছে।
আমি অনেক খুশি অইছি ভাই।
নানা চোখ মুছছে হাতের তালুতে। খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নানা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, মায়ের মুখে শুনেছি। সারা রাত ধরে তাঁর মুখে অনেক কথা শুনলাম। বলার সময় তাঁর যে আবেগ সেটা সচক্ষে দেখলাম। কি উচ্ছ্বাস আর উদ্যমতায় তাঁরা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরে। বন্ধুদের কথা, অপারেশনের কথা, খেয়ে না খেয়ে লড়াইয়ের গল্প! আমার উদ্দেশে বললেন:
তোমরারে দেহি টেলিভিশনে। তোমরাও বন্ধুরা মরলে রাস্তাত নামছিলা সবাই। তোমরারেও ভালা লাগে। আমার ছোটবেলার স্মৃতি মনে অয়। খুব ভালা। তোমরাও অনেক সাহসী। দেশের ভবিষ্যৎ। আমরা তো অহন বুড়া অইয়া পড়ছি।
হ্যাঁ, নানাভাই। আমিও গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের মতন হতে পারব না। তোমাদের অবদান সীমাহীন। অনেক বড় তোমরা।
ঠিকই কইছ। আমি যহন যুদ্ধে গেছিলাম, তহন আমার মা-বাবা আমারে কুরবানি দিছিল দেশের জন্য। তারাও অনেক কষ্ট সহ্য করছিল। সবার ত্যাগেই এই দেশ। আমার কাছে তহন রাইত আর দিনের পার্থক্য আছিল না। সারকথা, খালি চিন্তা করতাম কেমনে দেশটারে বাঁচাইবাম। কত রাইত যে ঘুমাইনাই!
নানার কথা শুনে আমার চোখ দিয়েও পানি বের হচ্ছে। দেশের জন্য এখনো তাঁর সেই একই টান। দেশ কী? তা যেন আমি হাতে–কলমে শিখতে এসেছি নতুন করে। তাঁর কাছে দেশ মানে নিশ্চিত শান্তি আর সুখের আশ্রয়।
আমি আগে কখনো এটা অনুভব করিনি। দায়িত্ববোধের সঙ্গে ভালোবাসা থাকলে সেই দায়িত্ব যথাযথ পালিত হয়। নইলে দায়সারা হয় সবকিছু। সুন্দর একটা দেশ আমরাও চাই, সবাই চায়। কিন্তু ত্যাগ কজন পারে? আমরা অন্যায়ে, দুর্যোগে এক হলেও আমাদের মধ্যে ভালোবাসার কমতি থাকে। আজ সেই ভালোবাসাটাও যোগ করতে জানলাম যেন।
পল্লবী, ঢাকা