আপা, তুই ভালো আছিস?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
বন্ধুরা পায় ছোট বোন। আর আমি পাই না, পাই না বলতে বলতে হঠাৎ বড় এক বোন পেয়ে গেলাম! কাছে আর যাইনি, দেউড়ি থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে রইলাম বোনের দিকে।

আম্মুর কোনো মেয়ে নেই। এর মানে হচ্ছে, আমার একটা বোন নেই; আম্মু কিংবা আব্বু কোনো কারণে বকা দিলে বোনের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই। বোনের সঙ্গে মিলে বরইয়ের মৌসুমে বরইয়ের আচার, আমের মৌসুমে আমসত্ত্ব খাওয়ার একটা সুস্বাদু অনুভূতি নেই। আব্বুর একটা আদরের দুলালি নেই। রান্নার সময় আম্মুকে সাহায্য করার কেউ নেই।

বন্ধুদের বোনদের দেখতাম আর আফসোস করতাম, ইশ! এমন একটা বোন যদি আমারও থাকত; আমিও তার সঙ্গে দুষ্টুমি, ঝগড়াঝাটি, মান-অভিমান করতাম। বোনের কাছ থেকে আদর পেতাম।

হঠাৎ একদিন শুনি বাড়ির লোকজন বলাবলি করছে, ‘তোর একটা বোন হয়েছে আজ। তোর বাপ, বোন বানিয়ে এনেছে।’ বোন কি আর বানানোর জিনিস! দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। আমার এহেন চঞ্চলতা দেখে আম্মা হাসলেন, কাছে টানলেন। বললেন, ‘পাশের বাড়ির কবিরের বিয়েতে ওনাকে (আব্বুকে) উকিল বাপ বানাইছে। সেই জন্য এহন কবিরের বউ অইল তোর বইন। বুঝলি?’
সেদিন মায়ের কথা ঠিক বুঝেছি কি বুঝিনি, সেটা আর এই মুহূর্তে সঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে একই দিনে মায়ের সঙ্গে গিয়ে বোনকে দেখে এসেছি। আম্মা ইশারায় দেখিয়ে দিলেন, ‘অই যে চুলার পাশে মোড়ায় বইয়া আছে, ওইটা তোর বইন, দেখ।’

বন্ধুরা পায় ছোট বোন। আর আমি পাই না, পাই না বলতে বলতে হঠাৎ বড় এক বোন পেয়ে গেলাম! কাছে আর যাইনি, দেউড়ি থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে রইলাম বোনের দিকে। হঠাৎ বোন আমার দিকে ফিরল। আমার যে কী লজ্জা, চটজলদি মাথা লুকিয়ে ফেললাম! পরমুহূর্তে আবার তাকালাম। বোনও আবার আমাকে দেখল। এবার আর পুরোপুরি মাথা লুকাইনি, দেহটা দরজার আড়ালে লুকিয়ে বিড়ালচোখা হয়ে তাকিয়ে রইলাম বোনের দিকে। বোন হেসে দিল। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। কাচুমাচু ভঙ্গিতে আবারও খানিকটা সরে এলাম। এ কী! বোন দেখি উঠে আসছে আমার দিকে! তখন এমন ভোঁ–দৌড় দিলাম! দৌড়াতে দৌড়াতে একেবারে নিজেদের ঘরে এসে পৌঁছলাম।

বয়সের তুলনায় আমি ছিলাম অতি লাজুক প্রকৃতির। এই লাজুকতা নিয়ে সহপাঠী কিংবা খেলার সাথি সবাই মজা করত। প্রাথমিক শেষে মাদ্রাসার ছাত্রজীবনেও এই লাজুকতা অনেকাংশে থেকে গিয়েছিল। নতুন কারও সঙ্গে মিশতে আমি একটু বেশি সময় নিতাম। জড়তা কাটিয়ে উঠতে অন্যদের তুলনায় একটু বেশি সময় লাগত আমার।

কবির ভাইয়ের বিয়ের তিন কি চার দিন পর সবাই গেলাম বোনের বাবার বাড়িতে। প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ। পথিমধ্যে আমাদের মাইক্রোবাস থেমে গেল। রেলক্রসিং হচ্ছে সামনে। দেখে আমার চোখ ছানাবড়া! একের পর এক বগি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, শেষ হওয়ার নাম নেই। রেলক্রসিংয়ের পুরোটা সময় জানালা দিয়ে মাথা বের করে তাকিয়ে ছিলাম। এটাই ছিল আমার প্রথম রেল দর্শন!

ইমতিয়াজ ভাইও সেদিন সঙ্গে ছিলেন। উনি সম্পর্কে জ্যেঠাতো ভাই। ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক ছাড়িয়ে ইমতিয়াজ ভাইকে অন্য একটা কারণে বেশি ভালো লাগত আমার। মানুষটা প্রচুর বই পড়ত। সেই সব বইই পরে আমি নিয়ে পড়তাম। মনে পড়ে, কোনো এক রাতে ওনার থেকে ধার করা কয়েকটা বই এনে এক রাতেই শেষ করে ফেলি। কথা ছিল যে পরদিন সকালেই ফেরত দিতে হবে। কারণ, তিনি সেগুলো ধার করে এনেছেন অন্য কারও কাছ থেকে। সময়মতো ফেরত না দিলে পরেরবার ধার করে বই আনা দুরূহ হয়ে যেত।

ঘটনাক্রমে ইমতিয়াজ ভাইয়ের এক সহপাঠীর বাসা ছিল বরল গ্রামের পাশে। বরল হচ্ছে আমার নতুন বোনের বাবার বাড়ি। সেখানে একটা মাদ্রাসা ছিল, মহিলা মাদ্রাসা। ভাইয়ের সহপাঠী আমাদের মাদ্রাসাসহ পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন। মাদ্রাসায় তখন চলছিল ছুটি। সে জন্যই দেখানো সম্ভব হয়েছে। অরণ্যের কোলে গড়ে ওঠা গ্রামটায় ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর। রাস্তাঘাট বা ছায়াতরুর মেঠো পথে মানুষের আনাগোনা খুবই কম। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল যেন আমরা নিশ্চিত কোনো পাহাড়ের গা বেয়ে ঘোরাঘুরি করছি। ইমতিয়াজ ভাইয়ের সহপাঠী আমাদের তাঁর বাড়িতেও নিয়ে গেলেন, অনেক সমাদর করলেন।

বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম বোনের বাড়িতে। পুরো বাড়িতে আপ্যায়নের তোরজোড় চলছে। বিভিন্ন ঢঙের থালায় হরেক রকম মিষ্টি–মিষ্টান্ন। কী নেই! ফলমূল থেকে শুরু করে প্রতিটা খাবারেই আভিজাত্যের ছোঁয়া। এই না হলো বোনের বাড়ির আপ্যায়ন। নজড় কেড়েছে মাঝারি আকারের প্লেটগুলো। প্রথমেই লাচ্ছা সেমাই রাখা, তার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কাজুবাদাম। প্লেটের একপাশে শুয়ে আছে বালিশের মতো দেখতে কয়েকটা রসমালাইয়ের দেহ। রসগোল্লাও সমান আদরে তাকিয়ে আছে। একটা সিরিঞ্জ পিঠা, যাকে গোলাপি রঙের শাড়ি পরানো হয়েছে! সিরিঞ্জ পিঠার অর্ধেকটা দেবে আছে সেমাইয়ে। সাজিয়ে রাখা আপেলের টুকরাগুলোও কম যায় না! এ কী! কমলার কোয়া দুটো এখানে কী করছে!

আমার আর তর সয়নি। একটা প্লেট হাতে নিয়ে শুরু করলাম তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার প্রস্তুতি। খাবার সাজাতে থাকা এক মহিলা হঠাৎ গজরাতে শুরু করল, ‘এই কে এটা? হুট করে এখানে ঢুকে খাওয়া শুরু করছে, যত্তসব!’ স্বাভাবিক, মহিলার কথা শুনে খুব ছোট মনে হলো নিজেকে। রেখে দিলাম প্লেট। অনেকগুলো মুখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী লজ্জার বিষয়! ইতিমধ্যে আমার বোনও এসে গেল। আমার যেন মুখ লুকানোরও সুযোগ নেই। ছিহ! মনে মনে নিজেই নিজেকে বকতে লাগলাম।

মহিলার প্রতি উত্তরে তৎক্ষণাৎ বোন কথা বলে উঠল, ‘এইটা আমার ভাই! ভাই, তুমি সবটা খাও। আরও নাও।’ একটা ঘর দেখিয়ে ইশারা করে বলল, ‘পাশের ঘরে গিয়ে বসো, আমি আরও আনছি তোমার জন্য।’ বোন তখন অতি কড়া নজরে তাকাল মহিলার দিকে। আহা, এই না হলে আমার বোন! ভাইয়ের জন্য বোনের কী দুর্দান্ত বদান্যতা। মহিলা যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। চুপসে গেল তার উগ্রতা।

বোন আমাকে টেনে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। ভরপুর দুটো প্লেট এনে সামনে রাখল। আমরা কুমিল্লার ছেলেরা বোনকে ‘আপা’ বলে ডেকে থাকি। আমার তখন বোনকে খুব বলতে ইচ্ছা করল, আপা তুই এত ভালো কেন? তুই তোর ভাইয়ের জীবনে কেন এত দেরি করে এলি? কিন্তু তা না করে অপলক তাকিয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম কি? বোন উঠে গিয়ে আমার জন্য জগ ভরে শরবতও নিয়ে এল। কী ভাগ্য আমার, একটা চমৎকার বোন পেয়ে গেলাম। কিন্তু সেদিন প্রথম দেখায় দেউড়ি থেকে বোনকে উঠে আসতে দেখে মনে হয়েছিল, পালিয়ে যেন বাঁচি।

স্রষ্টা হয়তো আমার জন্য বোনের আদর বেশিদিন লিখে রাখেননি। বোনকে নিয়ে অনভিপ্রেত একটা বিষয় সামনে আসে। বিষয়টা অনভিপ্রেত ঠিক, কিন্তু কখনোই অপ্রীতিকর নয়। সৃষ্টিকর্তাই এমনটা বানিয়েছেন বোনকে। তবে অযত্নে তো আর বানাননি।
শেষ অবধি বিয়েটা বেশিদিন টেকেনি! ব্যথায় ফেঁপে উঠছিল মনটা। টের পেয়েছিলাম এক অসহ্য দহন।

বোনকে সবাই ফেরদৌসি বলে ডাকত। এখনো মাঝেমধ্যে বোনকে মনে পড়ে। পাথরচাপা অনুভূতিগুলো নাড়িয়ে দেয় ভেতরটা। কতশত ক্রোশ দূরে আমি, জানি না আমার বোন এখন কেমন আছে, কোথায় আছে? বোন, তুই কি তোর ভাইকে মনে রেখেছিস? তোকে আপা বলে ডাকতে ইচ্ছা করে ভীষণ। আপা, তুই ভালো আছিস?

বরুড়া, কুমিল্লা