চির বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রতিবছর ডিসেম্বর মাস এলেই কোহিনূর বেগমের চোখেমুখে অন্য রকম দ্যুতি দেখা যায়। অতি আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার মতো না হলেও একধরনের নির্ভার, পরিতৃপ্ত, সৌম্যকান্তি ফুটে ওঠে শতবর্ষী এই বৃদ্ধার চেহারায়। তিন কুলে তাঁকে দেখার মতো কেউ নেই। অথচ একসময় কোহিনূর বেগমের ছিল বিশাল সম্পত্তি। প্রভাব-প্রতিপত্তি—কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।

নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানায় যখন বউ হয়ে আসেন, গায়ে ছিল ১০০ ভরি সোনার গয়না। শীতলক্ষ্যার তীরের এক গাঁ থেকে বড় ভাই এনে দিয়েছিলেন সাদা রঙের জামদানি। সেটায় ছিল আবার লাল পাড়, পুরো শাড়িতে সুরমাদানি মেটিফে সোনালি সুতায় হাতের কাজ করা। বাপের বাড়ি ছিল নেত্রকোনার আটপাড়া থানার তেলিগাতীতে। বাপের ছিল তেজারতির ব্যবসা, বড় ভাই ঢাকার গুলিস্তানে বিশাল বড় দোকান নিয়ে ক্যাসেট প্লেয়ারের ব্যবসা করতেন।

কোহিনূর বেগমের স্বামী শাহেদ চৌধুরী ছিলেন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বাপের অঢেল সম্পত্তি মরার আগে রেখে গিয়েছিল। ভাই-বোন কেউ ছিলেন না। সব সম্পত্তিই পান তিনি। এত দিন আপন বলতে ছিলেন কেবল মা। শাহেদ চৌধুরীর মা পছন্দ করে তাঁকে ছেলের বউ করে ঘরে নিয়ে আসেন। শাশুড়ি-বউমার ছিল গলায়–গলায় ভাব।

কোহিনূর বেগমের মনে পড়ে একাত্তর সালের কথা। বিদ্যুৎ নেই। কুপি জ্বলছে। শাশুড়ি আর তিনি বসে আছেন মাটিতে কাঠের পিঁড়ি পেতে। স্বামী বসে আছেন খাটের ওপর কোলবালিশে হেলান দিয়ে। হাতে রেডিও। হঠাৎ একটা বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…’। প্রায় ১৮ মিনিট পর শেষ হলো, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’ বলে। এর পর থেকে তার স্বামীর যেন কী হলো। সারা দিন ছটফট করেন আর ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করে ওঠেন ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ বলে। শাশুড়িও চিন্তায় পড়ে বলেন, ‘কওসেনে বউমা, আমার ছেড়াডা এডি কিতা নমুনা আরম্ভ করছে গো। আমার হইছে যত জ্বালা।’

এরই মধ্যে কোহিনূর বেগম জানতে পারেন, ঢাকায় গন্ডগোল শুরু হয়েছে। ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকায় পাখির মতো গুলি করে মানুষ মেরে ফেলা হয়েছে। ভাইয়ের ক্যাসেটের দোকানও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। প্রাণ নিয়ে ভাই-ভাবি পালিয়ে আসতে পেরেছেন।

হঠাৎ জুলাইয়ে এক বিকেলে তাঁর স্বামী জানান, যুদ্ধ করতে ট্রেনিং নিতে বর্ডার পাড় হবেন। শুনে কোহিনূর বেগমের আক্কেলগুড়ুম। এরই মধ্যে গ্রামে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প বসেছে। স্বামী যেই স্কুলে পড়াতেন, সেই স্কুল এখন শান্তি কমিটির দখলে। বাচ্চাদের পড়াশোনা বন্ধ। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ি থেকেও বের হন না। কিন্তু তিনি জানতেন, বাধা দিয়েও লাভ হবে না। তাই আপত্তি করলেন না। শাশুড়ি এ কথা শোনার পর রেগে যাবেন ভাবলেও মনে হলো, তিনি খুশিই হলেন। ছেলেকে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিলেন।

মাসখানেক পর কোহিনূর বেগম স্বামীর চিঠি পেলেন। চিঠিতে জানিয়েছেন, যুদ্ধের জন্য অনেক টাকা দরকার। তিনি যেন চিঠির বাহককে কিছু সোনার গয়না দিয়ে দেন। এভাবে আরও কয়েক দফা চিঠি নিয়ে পরপর তিনজন গভীর রাতে এসে কোহিনূর বেগমের কাছ থেকে সোনার গয়না নিয়ে যান। কোহিনূর বেগম বুঝতে পারেন, ওঁরা মুক্তিবাহিনীর লোক। শাশুড়ি এখন আর তাঁর সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলেন না। সারা দিন কোরআন শরিফ পড়েন আর তসবিহ নিয়ে ছেলের জন্য দোয়া করেন।

হঠাৎ এক রাতে বাড়ির দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকল একদল পাকিস্তানি আর্মি। কোহিনূর বেগমের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে জিজ্ঞেস করল, শাহেদ চৌধুরী কোথায়। কিন্তু কোহিনূর বেগম তা জানতেন না। জানলেও জীবন দিতেন, কিন্তু স্বামীর ঠিকানা দিতেন না। এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান শুক্কুর আলী তাঁকে নিয়ে গেলেন মিলিটারি ক্যাম্পে।

ছাড়া পেলেন ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে। শুনতে পেলেন, যুদ্ধ করতে গিয়ে ১০ দিন আগে শাহেদ চৌধুরী শহীদ হন। কবর দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে সহযোদ্ধারা তাঁকে মগড়া নদীতে ভাসিয়ে দেন। শাশুড়ি তাঁকে পেয়ে জড়িয়ে ধরেন। কোহিনূর বেগমের মতো অনেক নির্যাতিত নারীকে পরিবার গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেও তাঁর শাশুড়ি পরম মমতায় গ্রহণ করেন। বাপের বাড়ি থেকে বাবা-মা, ভাই-ভাবি সবাই এসে জড়িয়ে ধরেন।

এরপর তিনি স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে শাশুড়িকে নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। তাঁকে যেই রাতে ক্যাম্পে তুলে নেওয়া হয়, সেই রাতেই সব সোনার গয়না লুট হয়ে যায়। তবু তাঁদের দুজনের টাকার অভাব ছিল না। গ্রামের গরিব মেয়েদের পড়ালেখার জন্য স্বামীর নামে ট্রাস্ট করে দেন। গড়ে তোলেন পারিবারিক পাঠাগার। শাশুড়ির মৃত্যুর পর তিনি একদম একা হয়ে পড়েন। গ্রামের মানুষরাই তাঁর দেখাশোনা করেন। যেই শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান শুক্কুর আলী ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিও কোহিনূর বেগমের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে গেছেন। তিনি সবাইকেই ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ জন্যই বিজয়ের মাস ডিসেম্বর তাঁকে করে তোলে আরও মহিমান্বিত। বিজয়ের ভোরের লাল সূর্যের আলো তাঁর মতো অসংখ্য বীরাঙ্গনা মায়ের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের মানচিত্রে চিরভাস্বর করে রাখে।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা