লালসালু

কোলাজশাকিব হাসান

গ্রামের নাম মহব্বতপুর। এই গ্রামের মানুষ খাল-বিল ও নদী থেকে মাছ ধরা, বছরের বিভিন্ন সময়ে ধানসহ নানা ফসল চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। খেতে কাজ করার সময় কৃষকেরা একত্রে গান করে, ধান উঠে গেলে মেয়েরা গান গেয়ে গেয়ে ধান ভানে, বিভিন্ন ঋতুতে নানা উৎসব হয়। মাঝি গান গায় নৌকা বাইতে বাইতে, রাস্তায় ফেরিওয়ালা হেঁটে চলে আপন মনে গান গেয়ে, বিয়ে-পার্বণে মানুষ নানা কাজে আনন্দে মেতে ওঠে। প্রকৃতির রূপের ধর্মে তারা নিজেদের সাজায়। দৈনন্দিন কাজকর্মে প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে তারা এগিয়ে যায়।

গ্রামের মানুষেরা বেশির ভাগ অশিক্ষিত হলেও সহজ-সরল। গ্রামীণ কাজকর্মে তাদের জীবন ভালোই চলছিল। কিন্তু মজিদ গ্রামে প্রবেশ করার পর থেকে সবকিছু কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে যায়। মনে হয়, এত দিনের চিরচেনা সে গ্রামটা হঠাৎ অন্য রূপে প্রকাশিত হয়। গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের যে বিশ্বাসে সামাজিক জীবন গড়া, তা যেন মজিদের আগমনে সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
মজিদ দূরের গারো পাহাড় থেকে এসেছে। মধুপুর গড় থেকে দীর্ঘ তিন দিনের যাত্রা শেষে সে এই গ্রামে এসে উপস্থিত হয়। যদিও সে গ্রামবাসীকে বুঝাতে চেয়েছে, স্বপ্নে পাওয়া সৃষ্টিকর্তার আদেশে সে এই গ্রামে এসেছে মানুষকে ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে উদ্ধার করতে। কিন্তু তা যে আদৌ কল্পনা বা মুখরোচক গল্প ছিল, তা উপন্যাসের শেষে প্রমাণিত হয়।

গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খালেক ব্যাপারী ও মাতবর রেহান আলী। মজিদ তাদের শরণাপন্ন হয়। অচেনা ব্যক্তি গ্রামে প্রবেশের কারণে অনেক লোক ভিড় জমিয়েছে খালেক ব্যাপারীর উঠানে। সেখানেই মজিদ ধর্মের প্রতি এই গ্রামের মানুষের কত অনীহা, সেটা তাচ্ছিল্যের সুরে প্রকাশ করে।
খুব কম সময়ের মধ্যেই মজিদ লাল রঙের সালু কাপড়ে আবৃত একটি মাজার গড়ে তোলে। যার ওপর ভিত্তি করে মজিদের এই গ্রামে শক্ত অবস্থানের গোড়াপত্তন শুরু হয়। ধর্মের দোহাই ও বিভিন্ন কথা বলে মানুষের কাছ থেকে অনেক সুযোগ–সুবিধা গ্রহণ করে সে। সাধারণ মানুষ মাজারে আসে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য। কিন্তু তা আদৌ পরিবর্তন হয় কি না, তা বলা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়।
তাহের ও কাদের মজিদকে গ্রামে প্রবেশ করার সময়েই দেখেছিল। তাদের বুড়ো বাবা, আরেক ভাই রতন ও এক বিধবা বোন এবং তার মেয়ে হাসুনি একই পরিবারে থাকে। হাসুনির মায়ের গায়ে বুড়ো বাবার মারধরের বিষয় নিয়ে গ্রামে বিচার বসে এবং সেখানে মজিদ শাস্তি কার্যকর করে। এ ঘটনার কয়েক দিন পর বুড়ো মিয়া কোথায় চলে যায়, তার কোনো হদিস কেউ কোনো দিন পায়নি। মজিদ অবশ্য এ জন্য পরবর্তী সময়ে নিজেকে দোষারোপ করেছিল।

খালেক ব্যাপারীর দুই বিবি। প্রথম বিবি আমেনার কোনো সন্তান নেই। দ্বিতীয় বিবির সন্তান রয়েছে এবং তার এক ভাই ধলা মিঞা এ সংসারেই থাকে।
মজিদ গ্রামে আসার পর থেকে মানুষকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বেশির ভাগই তার নিজের মনগড়া এবং মাঝেমধ্যে মিথ্যা গল্পও শোনায় সে। আবার গোপনে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নেয়। মজিদ যে মাজারের ওপর ভিত্তি করে গ্রামে একজন সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে ওঠে, উপন্যাসের শেষে জানা যায়, দৃশ্যমান ঢিবিটি একটি কবর এবং মজিদ জানে না সেটি কার কবর। এ ব্যাপারটা যথেষ্ট বেদনাদায়ক এবং স্পর্শকাতর ও ধর্মের নামে অপব্যবহার।
মজিদ এই গ্রামের মানুষদের পানিপড়া দেয় অসুখ সারানোসহ নানা কারণে। পাশাপাশি অনেকটা জোরপূর্বক ধর্মীয় বিধানগুলো মানার জন্য বাধ্য করে। বাবা ও ছেলেকে বেঁধে একসঙ্গে খতনা করানো এর জলজ্যান্ত উদাহরণ।

সবার ঘরে যখন শস্য ওঠে, তখন গ্রামে পীরের আগমন ঘটে। এতে অবশ্য খুশি হয় না মজিদ। পীরেরা আসে সুসময় দেখে, যখন মানুষের হাতে অর্থ থাকে, ঘরে ফসল থাকে। অন্য গ্রামে পীর এলে মজিদের আয় কমে যায়। মানুষ তখন আর তার মাজারে তেমন আসে না।
মজিদের ক্ষমতা প্রকাশ পায় আরও কিছু ঘটনায়। সন্তান না হওয়ার কারণে খালেক ব্যাপারীর দীর্ঘদিনের বিশ্বাসী প্রথম বিবি আমেনাকে মজিদের পরামর্শে তালাক দেওয়া, গ্রামে স্কুল করার উদ্যোগ নেওয়া আক্কাস মিয়াকে অপমান করা ও স্কুল তৈরির কাজ বাদ দিয়ে মসজিদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনা। গ্রামের আর ১০ জনের সঙ্গে মিলে মজিদ বিচারকাজে নিজের ইচ্ছাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে শাস্তির বিধান করে থাকে। তাই গ্রামে মসজিদ হয়, কিন্তু স্কুল না হওয়ায় ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হতে পারে না।
রহিমা বিবির কোনো সন্তান না হওয়ায় মজিদ আবার বিয়ে করে জমিলাকে। অল্প বয়সী জমিলার নানা আচরণে বিরক্ত হয় মজিদ। অন্যদিকে জমিলাকে আদর–যত্নে নিজের সন্তানের মতো করে রাখে প্রথম বিবি রহিমা।
ধর্মের নামে এমন সুবিধা নেওয়া লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে সমাজে বাস করে আসছে। নিজেদের স্বার্থের জন্য সমাজকে আধুনিক হতে দেয় না তারা।