ভারত ভ্রমণের গল্প

রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লেখক

কলকাতা শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা থেকে মেট্রোপলিটন বিল্ডিংয়ের ফুটপাত ধরে চাঁদনি মার্কেটের পাশ ঘেঁষে চলে এলাম শিয়ালদহ রেলস্টেশনে। স্টেশন ইয়ার্ডে ঢুকতেই চোখে পড়ে তিনটা কুকুর। গেটের মুখেই বাঘের ভঙ্গিমায় বসে আছে। একটু ভয় পেয়ে অন্য পাশ দিয়ে ঢুকে পড়ি ইয়ার্ডে। সফরসঙ্গী চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভয় পাবেন না বাবু, এরা কামড়ায় না।’
কুকুরের ভয় কেটে গেলেও শত-সহস্র মানুষের ঠেলাঠেলির ভয় পেয়ে বসল। সফরসঙ্গী মাত্র ৫০ রুপি নিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে গেলেন। প্রায় ঘণ্টা তিনেকের ভ্রমণ। দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। ভাড়া মাত্র ২৫ রুপি। ভাবা যায়!

যাহোক, সেটা ভাবা যাক বা না যাক, আমাকে ভাবনায় ফেলে দিল শত-সহস্র যাত্রী ও ট্রেনযাত্রা। সবাই কত সুশৃঙ্খলভাবে ট্রেনে উঠছে। কোনো অযাচিত ঠেলাঠেলি নেই। কারও কোনো দুর্ব্যবহার নেই। কী দারুণ সবার আন্তরিকতা! কেউ বসছে। কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ঝামেলা নেই। নারীদের জন্য আলাদা কামরা আছে। তবু পুরুষদের কামরায় নারীরা এসেছে। কারও চোখে বিরক্তির লেশমাত্র নেই। বরং পারলে আসন ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!
এখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতেই হবে। নারীদের পোশাক। যে যার মতো পোশাক পরিধান করছে। কেউ কিছু বলছে না। এমনকি এ নিয়ে কারও টুঁ শব্দও নেই।

চুয়াডাঙ্গার জয়নগর আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলাম যেদিন, চেকপোস্টের ভারতীয় প্রান্তে অতিরিক্ত তল্লাশিতে মেজাজটা বিগড়ে যায়। তবে সেটা চেকপোস্ট পর্যন্তই। ভেতরে ভিন্ন চিত্র। তবু ফেরার দিন সে ধরনের ঝুঁকি নিইনি। এক দালালকে ১০০ রুপি দিয়েই কেল্লা ফতে করেছি। অবশ্য অন্য একটা কথাও শুনেছিলাম যে ভারতের অনেকেই মনে করে, বাংলাদেশ থেকে লোকজন এসে নাকি জাল ভোট দিয়ে যায়, তাই সীমান্তে এত কড়াকড়ি। সামনে আবার সেখানে নির্বাচনও।

জোর করে একটু হাসি দেওয়ার চেষ্টা করতেই তিনি বললেন, ‘বুঝলাম কেমনে, আপনাদের ওখানকার মানুষজন “বিমান” বলে। আপনিও বলছেন, তাই শুনে।’ তারপর বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো। ‘আমি অনেকবার গেছি বাংলাদেশে। অনেক উন্নয়ন হয়েছে ওখানটায়। মানুষজন অনেক ভালো। ৯০ শতাংশ মানুষই ভালো। আর আমাদের কলকাতায় মাত্র ১০ শতাংশ ভালো!’

নদীয়ার গেদে রেলস্টেশন থেকে যাত্রা শুরু। গন্তব্য কলকাতার দমদমে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ট্রেন ছুটছে। লোকাল ট্রেন হলেও গড় গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। ৫-১০ মিনিট পরপর বিভিন্ন স্টেশনে থামছে। ৩০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের জন্য। তাতেই যাত্রীরা নামছে ও উঠছে। প্রতিটি স্টেশনেই দৃশ্যমান জায়গায় গণশৌচাগার। অনেক পরিচ্ছন্ন সেগুলো।

জানালার ধারেই বসেছিলাম। যত দূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। চেনা-অচেনা, ছোট-বড় হাজার রকমের গাছ। মনে হচ্ছিল কোনো গহিন অরণ্যের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ভালো করে দৃষ্টি দিলেই চোখে পড়ে গাছের নিচে ঘরবাড়ি। পাকা দালান যেমন আছে, টিনের তৈরি জীর্ণ বাড়ির সংখ্যাও কম নয়।
দমদম রেলস্টেশনে নামতেই অঝোর ধারার বৃষ্টি স্বাগত জানায়। বৃষ্টি থামতেই ছুটলাম রেস্তোরাঁর খোঁজে। ভাত খেতে হবে। কিন্তু ভালো-মন্দ কোনো রেস্তোরাঁ-হোটেল মিলল না। কর্দমাক্ত পথে হাঁটছি। অবশেষে একটা বিরিয়ানির দোকানের দেখা মেলে। হালকা করে একটু খেয়ে রওনা দিই বিমানবন্দরের দিকে। কথার সুর শুনেই অটোচালক বুঝতে পারে, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তাই সে তার ইচ্ছেমতো ভাড়া রেখে দিল! কিছু করারও নেই, অচেনা শহর।

হায়দরাবাদের স্থানীয় খাবার, পোঙ্গাল ও উপ্মা
ছবি: লেখক

বিমানবন্দর এলাকায় উড়ালসড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলছে। এলোমেলো অবস্থা। সেসব পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বোর্ডিং পাস নিতে হবে। কাউন্টারের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সফরসঙ্গীর সঙ্গে কথা বলছি। হঠাৎ পেছনের ভদ্রলোক হেসে হেসে বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, না?’ একজন অপরিচিতের হঠাৎ এমন প্রশ্নে জোর করে একটু হাসি দেওয়ার চেষ্টা করতেই তিনি বললেন, ‘বুঝলাম কেমনে, আপনাদের ওখানকার মানুষজন “বিমান” বলে। আপনিও বলছেন, তাই শুনে।’ তারপর বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো। ‘আমি অনেকবার গেছি বাংলাদেশে। অনেক উন্নয়ন হয়েছে ওখানটায়। মানুষজন অনেক ভালো। ৯০ শতাংশ মানুষই ভালো। আর আমাদের কলকাতায় মাত্র ১০ শতাংশ ভালো!’ ভদ্রলোক আরও অনেক কিছু বলে গেলেন। জ্বলজ্বল করছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এর আলো গিয়ে ঠিকরে পড়ছে বন্দরের সামনের পাইকরের গাছে। মাঝারি আকারের খেজুরগাছে। আরও পেছনে ভারতের পতাকা। পতপত করে উড়ছে এই রাতেও। বোর্ডিংয়ের যাবতীয় কাজ শেষে বিমান উড্ডয়ন করল। গন্তব্য হায়দরাবাদ।

হায়দরাবাদ তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী। সেখানে যাচ্ছি চিকিৎসার জন্য। এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব গ্যাসট্রোএন্টারোলজি (এআইজি) হাসপাতালে। খুব নামকরা হাসপাতাল।

মাঝরাতে পৌঁছালাম হায়দরাবাদে। রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। একটি স্থানে লেখা, ‘ইউ আর ট্রান্সজিস্টিং থ্রু দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট পাংকচুয়াল গ্লোবাল এয়ারপোর্ট।’ আগে থেকেই হোটেল ও ট্রান্সপোর্ট ঠিক করা ছিল। কোনো ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই অসংখ্য বৃক্ষশোভিত আলোঝলমলে রাস্তা ধরে পৌঁছালাম গাছিবৌলি। সেখানেই এআইজি হাসপাতালটির অবস্থান।

মাইন্ডস্পেস রোডে হাসপাতাল। তার পেছন দিয়ে নেমে গেছে বাবুখান লেন। এই লেনেই আমাদের হোটেল। এখানে অধিকাংশ হোটেলই বাঙালিদের। হোটেল নিমন্ত্রণ, হোটেল বালাজী উল্লেখযোগ্য। বাংলা খাবারের জন্য বেগ পেতে হয়নি।

এআইজি হাসপাতাল প্রাঙ্গণ
ছবি: লেখক

পরদিন গেলাম হাসপাতালে। আন্তর্জাতিক ডেস্কে গিয়ে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সেরে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা। দেশি-বিদেশি অনেক রোগীই এসেছেন। ভিড় থাকলেও তা সহনীয় মাত্রার। অনেক পরিচ্ছন্ন ও নান্দনিক পরিবেশ। খুবই নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। চিকিৎসকদের ফি খুব বেশি নয়। রোগীর সঙ্গে কথা বলতে, সমস্যা শুনতে চিকিৎসকদের কোনো তাড়াহুড়া কিংবা বিরক্তিবোধ নেই। বাংলাদেশের মতো ওষুধ কোম্পানির এজেন্টদের কোনো আনাগোনা নেই। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সহকারীদের আচরণ অত্যন্ত মার্জিত; যেকোনো বিষয় খুবই আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে দেন তাঁরা।

তিন-চার দিনের মধ্যেই চিকিৎসাসংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সেরে রওনা হলাম কলকাতার উদ্দেশে। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে গাড়ি ভাড়া করলাম বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য। ৩৩ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য ভাড়া ৭০০ রুপি। অবশ্য আসার সময় মধ্যরাত হওয়ায় ১ হাজার ২০০ রুপি নিয়েছিল ড্রাইভার।
পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি আঁকাবাঁকা ও উঁচু–নিচু রাস্তা। অনেক প্রশস্ত সে রাস্তার বিভাজকে ও দুই ধারে ফুলগাছ, পাইনগাছসহ অন্যান্য গাছ রয়েছে। মাঝারি আকারের নানা বিলবোর্ডে ‘হায়দরাবাদ, দ্য আইটি হাব অব ইন্ডিয়া’সহ অনেক কিছু লেখা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, হায়দরাবাদের রাস্তায় রাজনৈতিক পোস্টার কিংবা কোনো ধরনের চিকামারা চোখে পড়ল না বললেই চলে। ৩৩ কিলোমিটারের রাস্তায় মাত্র দু-তিনটা স্থানে রাজনৈতিক পোস্টার দেখলাম! আরও চমকপ্রদ একটা বিষয় হলো বিমানবন্দরের আট কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাড়িঘর নেই!

সেখানকার স্থানীয় খাবারগুলো একদম ভিন্ন রকমের ও স্বাদের। উল্লেখযোগ্য খাবারের মধ্যে রয়েছে ইডলি, উপ্মা, দোসা, পোঙ্গাল, উত্তাপাম ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো খাবারগুলোতে রসুন, পেঁয়াজ কিংবা মরিচের কোনো বালাই নেই। কাঁচা, শুকনা, গুঁড়া—কোনো মরিচেরই ব্যবহার নেই। শুধু গোলমরিচ খুঁজে পেয়েছি। তা-ও অখণ্ড অবস্থায়। আপনি চাইলে খাবেন, না চাইলে ফেলে দেবেন।

বিমানে চিত্রনায়ক যিশু সেনগুপ্তের সঙ্গে লেখক

যাহোক, বিমানবন্দরে পায়ের জুতা খোলা ছাড়াই চেকিংয়ের প্রক্রিয়া শেষ হলো। বিমানে উঠে চোখ বন্ধ করে দোয়া-দরুদ পড়ছি। হঠাৎ চোখ খুলে ভীষণ আশ্চর্য হলাম। বাঁ পাশের আসনে এ কাকে দেখছি? সঠিক লোককেই দেখছি তো? এরই মধ্যে সেই ব্যক্তির ডান পাশের যাত্রী অনুমতি ছাড়াই তাঁর সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে গেলে নিশ্চিত হলাম, তিনি জনপ্রিয় চিত্রনায়ক যিশু সেনগুপ্ত! ‘এক্সকিউজ মি’ বলে কথা বলা শুরু হলো। তারপর নানাবিধ কথা বলতে বলতে চলে এলাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বিমানবন্দরে। নায়ক তাড়াহুড়া করে নেমে গেলেন, যাতে পাবলিককে এড়ানো যায়।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ধর্মতলা যাচ্ছি। বাসে করে। তাকিয়ে তাকিয়ে শহরটাকে দেখছি। শুনেছি, এ এক তিলোত্তমা শহর! সত্যি তা–ই। আমার দেশের দেখা অনেক শহরের বিপরীতে এ শহরকে ভালো লাগল বিশেষ কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে এর যত্রতত্র বেশুমার গাছ। নানা রকমের গাছ। সবুজের অপার সমারোহ। ব্রিটিশ পিরিয়ডের অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর দালান রয়েছে। অনেক পুরোনো দালানের গায়ে পাখির বিষ্ঠা থেকে গজিয়ে ওঠা বটগাছগুলোও প্রায় মহিরুহ। তবু কেউ সেগুলো নিধন করে না! নগরবাসীর সংখ্যা অনেক হলেও ঢাকা শহরের মতো অসহনীয় যানজট নেই!

হঠাৎ বৃষ্টি নেমে আমার দৃষ্টি রুদ্ধ করে দেয়। বাসের ভেজা গ্লাস। অগত্যা কথা বলা শুরু করি পাশের আসনের ভদ্রলোকের সঙ্গে। পরিচয় ও ভূমিকা শেষে তিলোত্তমার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমকালীন রাজনৈতিক আবহাওয়া—বাদ যায় না কিছুই। দুটি বিষয় খেয়াল করি তন্ময় হয়ে। তাঁর হিন্দিমিশ্রিত বাংলা বলার বেসুরো ঢং। অন্যটি ইংরেজি ভাষার ওপর চমকপ্রদ কমান্ড। তিনি কলকাতা পৌর সংস্থার কেরানি পদের একজন চাকুরে!

মোহাম্মদ আলী পার্ক পেরিয়ে যাই। ধীরে ধীরে যশোর রোডের এ মাথায় ‘ভালো থাকবেন। আদাব।’ বলে বাস থেকে নেমে যান ভদ্রলোক।

তাঁর দ্বিতীয় দক্ষতায় মোহাবিষ্ট আমি। চোখে ভাসে আমার দেশের অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত কেরানিদের ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা!

উপদেষ্টা, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা