‘সত্তা’ চলচ্চিত্র একটি বহুমাত্রিক তরঙ্গায়িত আলোর সন্ধান। মানুষের মনের গহিনের অন্ধকার থেকে পদে পদে ব্যক্তিমানুষের জীবনের এবং সমাজজীবনের অন্ধকার জগৎ থেকে আলোতে উত্তরণের পথে তীব্র সংঘাত, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এখানে মেলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
সোহানী হোসেনের বেশ শক্তিশালী জোরালো সুন্দর গল্পটির মধ্যে কাঁটাতার আছে, জীবনের পরতে পরতে অদৃশ্য কাঁটাতারও বিস্তৃত হয়। সীমান্ত অঞ্চলের পেটের দায়ে পড়ে একশ্রেণির মানুষের চোরাচালান, গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার বাস্তব দর্পণ, লাশ কাটা ঘরে ডোম স্বামীর সামনে স্ত্রীর লাশ এসে হাজির হওয়া, মাতাল ডোমের মনোবৈকল্য, সন্তানের তুলে দেওয়া স্বর্ণ দিয়ে ছয় বোতল মদের বিনিময়েও লাশ কাটতে রাজি না হওয়া বা লাশ কাটতে না পেরে ওঠা, একদিন আবার সেই সন্তানের লাশ এসে ডোমের সামনে অগ্নিপরীক্ষা।
‘সত্তা’ নামের এই চলচ্চিত্র আপন সত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, বলীয়ান। শাকিব খান নিজেকে মেলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন।
গল্পটার মধ্যে কী নেই? মায়ের লাশ ছাড়তে দেওয়ার অজুহাতে বদমাশ চিকিৎসকের মৃত মায়ের কন্যার শরীর ভোগ করতে চাওয়া। কন্যার গ্রাম থেকে শহরে পালিয়ে এসে বারবার শহুরে দুষ্কৃতিদের পাল্লায় পড়া। গ্রাম হোক বা শহর—সর্বত্রই যে এখন অন্ধকারে হানাদারের করাল থাবা। লোভ–লালসার হাত থেকে নিষ্পাপ হরিণীর আপন শরীরের মাংস বাঁচানোর জন্য বারবার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো। যৌনপল্লিতে পতিতাদের মধ্যে এসে আশ্রয় পাওয়া। সে পথে না গিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য ফুল বিক্রি করতে গিয়েও শরীর গরম হয়ে আসা শহুরে পোশাকি সভ্যতার অসভ্য মানুষের থাবার মুখে পড়া। বিচিত্র সব মানুষের জীবন এবং জীবিকার সঙ্গে বাস্তবের চলমান জীবনের ছবি। এই সুন্দর কাহিনিকে অনবদ্য সংলাপ, চিত্রনাট্য রূপ দিয়েছেন ফেরদৌস হাসান। সুনিপুণ মুনশিয়ানায় ঘটনার ঘনঘটার মালা গাঁথার মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন হাসিবুর রেজা কল্লোল।
অনেক বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে এলেবেলে ছেলে ভোলানোর গল্প দাঁড় করিয়ে বড় বড় নায়ক-নায়িকার নাম ভাঙিয়ে, নায়কোচিত কাণ্ডকারখানায় চালানোর চেষ্টা করা হয়। আবার যেকোনো বড় নায়ক, তিনি যদি পাথরের মতো বারবার নিজেকে ভাঙতে না জানেন; তবে নিত্যনতুন ভাস্কর্যের মতো গড়ে উঠবেন কী করে? সেদিক থেকে ‘সত্তা’ নামের এই চলচ্চিত্র আপন সত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, বলীয়ান। শাকিব খান নিজেকে মেলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন। সঙ্গে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নতুন একটি পালকজুড়ে যেতে পারলেন কলকাতার পাওলি দাম। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের প্রয়োজনমতো অধিকাংশ মানুষের মনোরঞ্জনের খোরাক রঙিন নাচ–গান এসব এসেছে। গল্পের আবেদন কিন্তু সমস্ত গ্ল্যামারের জগৎকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে। মমতাজ, জেমস, পান্থ কানাই এবং অন্য সবার গানগুলোও মনে রাখার মতো। শুরুর সংগীতটি তো গুনগুন করা যায়।
শাকিব এমনই দুর্দান্ত গল্পনির্ভর অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। কলকাতার পাওলিও নিজেকে বর্ণময়, সৃষ্টিশীল রাখার কাজটি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন।
শাকিব খান এখানে শহুরে বড়লোক ঘরের মাদকাসক্ত ছেলে সবুজ। কংসের মতো মামা–মামি বিষয়সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে নেশাগ্রস্ত করে রাখে। সেই মাদকাসক্ত যুবকটিকে শিখা নামের মেয়েটির প্রেম এসে বদলে দেয় একদিন। এই শিখা হলো পাওলি দাম। মাদকাসক্ত যুবক মাদকবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। সমাজ বদলে দেওয়ার কিছু কিছু টোটকাও সে ব্যবহার করে। শিক্ষাদানের নামে যারা প্রশ্নপত্র বিক্রি করে, সেই সব অসাধু শিক্ষকের মুখোশ খুলে দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশের যুবসমাজকে বিপথে চালিত করতে যারা মাদক ছড়িয়ে ব্যবসা করে, তাদের ওপরে মাদক প্রয়োগ করে। টিভি চ্যানেলে বুদ্ধিজীবী সেজে ঝগড়াঝাঁটি করে যে দুপক্ষ সারাক্ষণই মানুষকে বোকা বানায়, তাদেরও শায়েস্তা করে। এ ধরনের ঘটনাগুলো সমাজ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার মধ্যে আনন্দ–রসেরও ধারা বইয়ে দেয়।
গল্পের জীবন বিধ্বস্ত শিখা মারা গেলেও সন্তানের জন্ম দিয়ে সবুজের জন্য নতুন আশার দিগন্ত ছড়িয়ে রেখে যায়। মাতাল বাবা ভালো হয়ে গিয়েও সন্তানের লাশ কাটার মতো ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। গল্পের এই মোচড়গুলো চিরকাল মনে রাখার মতো।
ডন, রীনা খান, কাবিলা, নাসরিন, শামীমা নাজনীন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, বীথি রানী সরকার, শবনম পারভীন, শিমুল খান—সবার অভিনয় ভালো লাগে। বাপ্পা মজুমদারের সুরারোপ ঘটনা, পরিস্থিতি, অবস্থান অনুযায়ী বেশ মনে রাখার মতো। আসাদুজ্জামান মজনুর ক্যামেরার ভাষাও সুন্দর। শামসুল আরেফিন সাদি যোগ্য সম্পাদক। তবে যে গল্পের জাদুর কথা শুরু থেকে লিখে এসেছি, নায়ক–নায়িকার স্বপ্নে বিভোর কাল্পনিক নাচ–গান রোমান্টিক দৃশ্যের বাইরে এসে, গল্পের চিত্রায়ণ আরও একটু দীর্ঘ হতে পারত। শাকিব খানের ফ্যান–ফলোয়ার তাতে আশা করি কমত না। ইতিমধ্যে শাকিব এমনই দুর্দান্ত গল্পনির্ভর অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। কলকাতার পাওলিও নিজেকে বর্ণময়, সৃষ্টিশীল রাখার কাজটি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত