তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘গাড়িয়াল ভাই’। গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সমাজজীবন, জনজীবন থেকে উঠে আসা কাহিনিকে এই চলচ্চিত্র শিল্পায়িত করে। কিংবদন্তি লোকসংগীতসম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের পানে চাইয়া রে...’ মন কেমন করা জনপ্রিয় গানটির নামকরণে একটি সার্থক রূপায়ণও বলা যেতে পারে এই চলচ্চিত্র। আব্বাসউদ্দীনের গানটি সুযোগ্যা কন্যা জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে বা বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠে সমগ্র বাঙালি জাতির হৃদয় ছুঁয়েছে, দেশে-বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্য বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও চিত্রায়িত হয়েছে নানা সময়ে। ‘গাড়িয়াল ভাই’ চলচ্চিত্রেও সাবিনা ইয়াসমিনের দরদি কণ্ঠে এবং অঞ্জু ঘোষের ব্যাকুল অভিনয়ে বাঙালি হৃদয়ে চিরকালীন আসন পেতে নিয়েছে এই গান। আবার তোজাম্মেল হক বকুলের মতো অকালপ্রয়াত পরিচালকও গ্রামবাংলার লোকজীবনকে চিত্রায়িত করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। গ্রামের গল্প তুলে আনা, মাটির সুরে কথা বুনে চলা, ধরে ধরে দৃশ্য নির্মাণ—সবকিছুতেই তিনি চলচ্চিত্র জগতের একজন নিপুণ চাষা।
এই চলচ্চিত্রেও আমরা দেখি, মোড়লের বোন কুসুমের সঙ্গে প্রেম হয় কদম গাড়িয়ালের। গ্রামের এক ‘মাস্টারের মাইয়া বাড়ির কামলার লগে ফস্টিনস্টি করতাছে’ জানতে পেরে সালিশি সভা বসিয়ে মোড়ল নিদান দেন, ‘গ্রামের কোনো যুবক-যুবতী যদি প্রেম করে। মাইয়ার কপালে কলঙ্কের ছেঁকা নিতে হইব। আর ছেলেরে একশটা দুল্লা মারা হইব।’ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এভাবে নারী নিগ্রহ, নারীর প্রতি কঠোর বিধান; শহীদুল্লা কায়সারের রচনা অবলম্বনে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একসময়ের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’-এও দেখেছি। এই নাটকে ‘হুরমতি’ চরিত্র ফেরদৌসী মজুমদারের কপালে এভাবে সিক্কার ছেঁকা দেওয়া হয়েছিল। সেই ছেঁকা দেওয়ার অভিনয়ের প্রাবল্য এতটাই প্রকট ছিল যে আমার মতো খুদে দর্শকেরও মন কেঁদে উঠেছিল। এই চলচ্চিত্রে আমরা দেখছি মেয়ের জন্য সালিশি সভায় অপমানিত হয়ে শিক্ষক পিতা চরিত্রের অভিনেতা আনোয়ার হোসেন নিদান মেনে নিচ্ছেন। আবার মেয়ের কপালে ছেঁকা লাগার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে নিজেও মারা যাচ্ছেন।
উঁচু জাতি বিত্তবান ঘরের সন্তানের সঙ্গে নীচু জাতি গরিবের প্রেম হতে পারে না। মোড়লের বোন নিজেই তো গাড়িয়ালের প্রেমে পড়েছে। গাড়িয়ালের ধনসম্পদ কিছু নাই। আছে শুধু বুকভরা প্রেম। খেটে খাওয়ার জন্য একটা গরুর গাড়ি আর একটা চাবুকও আছে। গাড়িয়ালের চাবুকটাকেও এই চলচ্চিত্রের মূল বার্তার একটা সাংকেতিক চাবুক বলা যেতে পারে। কদম গাড়িয়ালের নিজের ভাষায়, ‘এই চাবুকটা আমার ইজ্জত, আমার বংশের নিশানা। বাপজান মরণের সময় এটা আমার হাতে তুইলা দিছিল। এই চাবুকটা আমার একমাত্র সম্বল, আমার জীবন।’ এই সংলাপগুলোও পরবর্তী সময়ে ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়। মোড়লের বোন কুসুম গয়না, অলংকারের বদলে গাড়িয়ালের চাবুক হাতে তুলে নিয়ে, হার বানিয়ে গলায় পরে নেয়। কদমকে বলে, ‘এই চাবুকটা তোমার একমাত্র সম্বল, তোমার জীবন, তোমার বংশের ইজ্জত। আইজ আমি তোমার ইজ্জতের মালা গলায় পরলাম।’ এদিকে সেই অপরাধে মোড়ল প্রাণপ্রিয়া বোনকেও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। ছোট ছোট দুই সন্তান রেখে একসময় কদম মারা যায়।
মোড়ল বড় মাছের মাথা খেতে পারত না। বোন কুসুম একমাত্র জানত মূল কারণ, ‘কাঁটা বাইচা না দিলে তুমি অহনো খাইতে পারো না।’ বোন কাঁটা বেছে দিত, মোড়ল খেত। সেই একই সংলাপ একসময় আমরা শুনলাম মোড়লের মেয়ের মুখে। মেয়ে বাবাকে মাছের মাথার কাঁটা বেছে দিত।
আবার কুসুমের সঙ্গে কদমের প্রেমপর্ব চলাকালে কুসুম আঁচলে ভরে মুড়ি নিয়ে আসত কদমের জন্য। কদমকে গামছায় দিতে চাইলে সে বলত, ‘আমার লাইগা যার এত মায়া তার মুড়ি আমি গামছায় নিমু না। মুড়ি মাইয়া মাইনসের আঁচলেই মানায়, গামছায় না। সারা জীবন তো গামছায় বাইন্দা মুড়ি খাইলাম, কোনো স্বাদ পাইলাম না। আজ আমারে যে মাইয়া করে, তার আঁচল থেইকা মুড়ি খাইয়া পেট ভরামু।’
কদমের ছেলে গ্রামের নতুন গাড়িয়াল যখন মোড়লের মেয়ের প্রেমে পড়েছে। দুজনের প্রেম জমে উঠে। মোড়লের মেয়ে একইভাবে প্রেমিকের জন্য মুড়ি নিয়ে এলে, প্রেমিক একই সংলাপ বলে যায়। ঘটনার বাঁকে বাঁকে এভাবে সংলাপেরও পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। চলচ্চিত্রের এই নতুন গাড়িয়াল হলেন ইলিয়াস কাঞ্চন আর মোড়লের মেয়ে অঞ্জু ঘোষ। এই নবতরঙ্গের প্রেম যমুনা যখন উথালপাতাল, দূর থেকে তা দেখে অভিনেতা দিলদার বলে, ‘ঘটনা প্যাঁচ খাইছে, ভালোভাবেই খাইছে। অহন আমার আতুড়ির লগে প্যাঁচ খাইগা।’ দিলদার বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের প্রকৃতই হাস্যরসের সম্রাট। চলচ্চিত্রে আতুড়ির সঙ্গে তার প্রেমপর্বটিও বেশ জমিয়ে দেওয়ার মতো।
পরিচালক শেষে এসে মোড়লের মেয়ের সঙ্গে গাড়িয়ালের মিলন দেখান। মোড়ল বোনের কাছে এসে পুরোনো ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন। বোনের হাত থেকে পুরোনো চাবুক নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার মতো নিজেই নিজের পিঠে চাবুক কষান। এভাবেই ধনী-গরিবের সামাজিক বৈষম্য ঘুচে যায়। আবার বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ যে কত বড় মাপের শিল্পী, তাঁদের জুটি যে কতটা শক্তিশালী ছিল, তা–ও ইতিহাসের কাছে প্রমাণস্বরূপ থেকে যায়।
আনন্দমেলা চলচ্চিত্র লি. প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কবিতা, সুষমা, আব্বাস, খালেদা আক্তার কল্পনা, প্রবীর মিত্র, নাদের খান, সাইফুদ্দিন, নাসির খানসহ আরও অনেকে।
গ্রামবাংলার রাস্তায় এখন আর গরুর গাড়ি বা গাড়িয়াল ভাইদের খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু এই পেশার মানুষ যে একসময় ছিলেন, তারও সাক্ষ্য বহন করে যাবে চলচ্চিত্রটি।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত