১৫ জুলাই, রাত তখন ১০টা। আকাশে সারি সারি মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। কিছুক্ষণ পরপর আকাশে তীব্র আলোকচ্ছটা সৃষ্টি হচ্ছে। বিজ্ঞান বলে, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জযুক্ত দুটি মেঘ কাছাকাছি এলে আকর্ষণের ফলে চার্জ এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে দ্রুত ছুটে যায়। ফলে ইলেকট্রনের গতিপথে একপ্রকার তীব্র আলো উৎপন্ন হয়, তাকে বিদ্যুৎ চমকানো বলে। আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। একটু পরপর তীব্র শব্দে মনে হচ্ছে, এখনই আকাশ ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।
নাফিজ, জুয়েল, নাজমুল, ফুয়াদ আর আমি এসএই মোড়ে ফয়সাল মামার চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি। শিমুলতলির সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জনবহুল মোড়ের নাম এসএই মোড়। মোড়ের নাম এসএই কেন আমার জানা নেই।
মিছিলটি এসএই মোড় থেকে ডুয়েট সেকেন্ড ক্যাম্পাসের দিকে যেতে যেতেই বিশাল এক মিছিলে পরিণত হলো। আশপাশের মেস থেকে সারি সারি মিছিল যুক্ত হচ্ছে আমাদের মিছিলে। রাত তখন ১১টা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
চায়ের প্রতিটা চুমুকে চুমুকে চলছে তুমুল রাজনৈতিক আলাপ, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। স্বৈরাচার সরকার কি আদৌ আমাদের ন্যায্য দাবি মেনে নেবে? কোটাবৈষম্য কি দূর হবে ইত্যাদি।
ফয়সাল মামা চায়ের কাপে চিনি ঘুঁটছেন। টং টং শব্দ। চায়ের দোকানের সবচেয়ে সুন্দর এবং সুপরিচিত শব্দ হলো কাপে চামচ দিয়ে চিনি ঘুঁটা। মামা চিনি ঘুঁটতে ঘুঁটতে নিজের মতামত প্রকাশ করে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় শরিক হচ্ছেন। রাজনৈতিক আলোচনার এই এক মজা, আশপাশের সবাইকে শরিক হতেই হবে। আলোচনায় সায় না দেওয়া মানে মস্ত বড় অপরাধ।
শীতের সকালে গ্রামে চায়ের দোকানগুলোতে চলে সাবানা-আলমগীরের সিনেমা। কখনো মান্না কিংবা ইলিয়াস কাঞ্চনের সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। সিনেমা দেখতে দেখতে চলে তুমুল রাজনৈতিক আলোচনা। ধান বুনন করতে করতে চলে নির্বাচনী খোশগল্প। কে কত ভোট পাবে, কার ফিল্ড কতটুকু ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি। নির্বাচন এলে কিংবা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলেই দেখা যায় এসব চিত্র। প্রতিটা চায়ের দোকান পরিণত হয় ভ্রাম্যমাণ সংসদে!
ফয়সাল মামার দোকানেও তা–ই। মামা বললেন, ‘বুঝলা মামারা! ওহন আর রইক্ষা নাই শেখের বেটি হাসিনার। ছাত্র বেডাইন যেইভায় নামতাছে, তাতে মনে ওয় ঠাইন্যা হেছড়াইয়া নামাইবার পারে। ছাত্ররারে ক্ষেপাইয়া আইজ পর্যন্ত কোনো বেডায় গদিত টিকতে পারে নাই। নব্বইয়ের ছাত্র আন্দোলনে এরশাদের পতন ওইছিল। তোমরা তখন ছোড। এরশাদের পতন আমরা দেখছি নিজের চক্ষে। তয় মামারা একটা কথা কই, রাগ কইরো না।’
জুয়েল বলল, ‘হ্যাঁ মামা, বলেন। কী কথা?’
‘আচ্ছা মামা! দেশের হগল কলেজ, ইনুভার্সিটির ছাত্ররা আন্দোলনে নামছে, তয় তোমরা নামবা না? ডুয়েটের ছাত্ররা নামব কবে? নাকি…’।
নাফিজ, জুয়েল, নাজমুল আর ফুয়াদ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আমি ফোন চাপছি আর মামার কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছি। ফোন স্ক্রল করতে করতে স্কিনে ভেসে এল সূর্যসেন হলের একটি ভিডিও চিত্র। হলের ভেতরে স্লোগান হচ্ছে, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। ভিডিওটা সম্ভবত এক দিন আগের; অর্থাৎ ১৪ জুলাই রাতের। ভিডিওটা বন্ধ করে ফোনটা টেবিলের ওপর রাখলাম। ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলতে পারিস, ডুয়েট এরিয়ায় অ্যাডমিশন এবং জব কোচিংয়ের শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় কত হবে?’
সে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘এভাবে তো হিসাব করে দেখিনি। তবে ১০-১৫ হাজার তো হবেই বা আরও বেশি। কিন্তু কেন?’
‘স্লোগান ধর। আর বসে থাকা উচিত হবে না।’
এটা শোনার পর সবাই যেন একটু ধাক্কা খেল। নাফিজ চায়ের কাপ সরিয়ে তাচ্ছিল্য করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অপূর্ব, তুই পাগল হয়েছিস? যেখানে ডুয়েটের শিক্ষার্থীরা চুপ করে আছে। কোনো আন্দোলন করছে না, আর তুই কি না জব প্রিপারেশন কোচিংয়ের শিক্ষার্থী হয়ে করবি আন্দোলন!’
‘যা ভাই, পেট্রোবাংলায় উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দিছে, ১০ জন নেবে। আবেদন কর, তোর চাকরি হয়ে যাবে। চাকরি কর গিয়ে।’
‘হাঁ হাঁ, জানতাম, পীপিলিকা নাকি পাখা গজায় মরিবার তরে। তোরও তা–ই হয়েছে। বাদ দে ভাই, বৃষ্টি আসবে, চল মেসে যাই।’ নাজমুল বলল।
‘না, মেসে যাব না। এখন থেকেই এবং এখান থেকেই শুরু হবে গাজীপুরের ছাত্র আন্দোলন।’
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে বসে চা খাচ্ছে তিনজন ডুয়েটিয়ান। তারাও হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে একজনকে চিনি, আলিম ভাই। তিনি পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এসে বসলেন আমার সামনের বেঞ্চিতে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘অপূর্ব! তোমরা ক্যাম্পাসের বাইরের শিক্ষার্থী। কেউ অ্যাডমিশনের, আবার কেউ জব প্রিফারেশনের। তোমরা হল ছাত্রলীগ কিংবা ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তোমাদের কিছু করতে পারবে না। তা ছাড়া এই এলাকায় ডুয়েটিয়ানদের চেয়েও সংখ্যায় তোমরা বেশি। তোমরা আন্দোলনের ডাক দাও, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা আসব। এখন হলের ভেতরে চলছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ট্রমার মধ্যে আছে। কেউ দম ফেলার সাহস পাচ্ছে না। তোমরা আন্দোলন শুরু করো, আমরা সবাই আছি।’
আলিম ভাইয়ের কথায় সবাই কিছুটা আশ্বাস পেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। দেখি, দোকানে দোকানে শিক্ষার্থী ভরপুর। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ ফোন চাপতে ব্যস্ত।
সবার মাঝখান থেকে ফুয়াদ স্লোগান ধরল, ‘তুমি কে আমি কে…’
তাকিয়ে দেখি, মুহূর্তেই দোকান থেকে সারি সারি সব শিক্ষার্থীরা একত্রে জড়ো হয়ে গেল। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠল এসএই মোড়। একটু আগেও যে মোড়টি থমথমে ছিল। সবার মুখে ফুটে উঠছে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। চোখেমুখে ভেসে উঠছে তীব্র ঘৃণা আর নিন্দা।
মিছিলটি এসএই মোড় থেকে ডুয়েট সেকেন্ড ক্যাম্পাসের দিকে যেতে যেতেই বিশাল এক মিছিলে পরিণত হলো। আশপাশের মেস থেকে সারি সারি মিছিল যুক্ত হচ্ছে আমাদের মিছিলে। রাত তখন ১১টা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বিশাল এক মিছিল নিয়ে আমরা রওনা হলাম ডুয়েট মূল ক্যাম্পাসের দিকে। ডুয়েটের সামনে আমরা সবাই এসে দাঁড়ালাম, মিছিল হচ্ছে মূল ফটকের বাইরে। নানা স্লোগানে মুখর চারপাশ। বৃষ্টি ক্রমে বেড়েই চলেছে।
বন্ধু, গাজীপুর বন্ধুসভা