মায়ের প্রতি ভালোবাসা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

নজি একটি নাম, এক অদ্ভুত চরিত্র, এক বেঁচে থাকার গল্প। পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত এক গ্রামে তার জীবন যাপন যেন বাতাসে ভাসমান পাখির বাসা। কোনো নিশ্চিত আশ্রয় নেই, নেই কোনো সংরক্ষিত ভবিষ্যৎ। বাবা নেই, স্বামী নেই—আছে শুধু তার মা, যিনি নিজেও বাস্তবতার ভার বইতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এই মা-মেয়ের সংসার চলে গ্রামবাসীদের ছোটখাটো কাজে সহায়তা করে, কখনো ধানের গোলায়, কখনো কারও উঠান ঝাঁট দিয়ে।

শীতের এক সকাল ছিল সেদিন। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশ, বাতাসের শিহরণে শরীর কেঁপে উঠছিল বারবার। নজি আর তার মা বিবিজান ছোট্ট উঠানের এক কোণে শুকনা পাতার আগুন পোহাচ্ছিল। অবচেতন মনে কখন যে বিবিজানের পরনের শাড়িতে আগুন লেগেছিল, কেউ টেরও পায়নি। মুহূর্তের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে কাপড়ের অংশ, আর বিবিজানের শরীরের এক–তৃতীয়াংশ পুড়ে যায়।

নজির সামনে ঘটেছিল সব, কিন্তু তার মানসিক অসংলগ্নতা তাকে বোঝাতে পারেনি, কী করতে হবে! তার হতভম্ব চোখের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা, মায়ের আর্তচিৎকার, আর নিজের এক অসহায় অস্তিত্ব। প্রতিবেশীদের ডাকাডাকিতে দৌড়ে আসে কয়েকজন, নজির চাচারাও এগিয়ে আসে। তারা মিলে বিবিজানকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

হাসপাতালের কঠিন দিনগুলোয় নজির চাচিরা সেবার ভার নিয়েছিল। অথচ নজি? সে যেন নিজের মধ্যেই হারিয়ে গিয়েছিল। কয়েক দিন পর আচমকা তার মনে হলো, মাকে দেখতে যাওয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে যাবে? তার তো একমুঠো টাকাও নেই।

নজি বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদী থেকে কিছু পাথর কুড়িয়েছিল, যা ছিল তার হাতের পাঁচ। সেগুলো সে স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করল, পেল মাত্র ২০০ টাকা। সেই সামান্য অর্থের মধ্যেই সে ভাগ করে নিল মায়ের প্রতি তার ভালোবাসা। ৪০ টাকা দিয়ে কিনল আঙুর, ৬০ টাকায় দুটি আপেল। তারপর হাতে যা রইল, তাতেই যাতায়াতের খরচ মেটাল।

অবশেষে সে পৌঁছাল হাসপাতালে। বিবিজান তখনো ক্লান্ত, সুস্থ হয়ে উঠছেন ধীরে ধীরে। নজি তার হাতে তুলে দিল আঙুর ও আপেল। মায়ের চোখে সে কী বিস্ময়, ভালোবাসা! নজির চোখে ছিল গভীর প্রশান্তি।

ভারসাম্যহীন নজির মুখে তার অগোছালো বর্ণনায় খুঁজে পেলাম মায়ের প্রতি একরাশ ভালোবাসা।

সবার চোখে সে মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু মায়ের প্রতি তার যে টান, যে দায়িত্ববোধ, তা কি যেকোনো সুস্থ মানুষের চেয়ে বেশি নয়? ভালোবাসার সংজ্ঞা কখনো কখনো যুক্তির বাইরে, সমাজের নিয়মের বাইরেও। আজ তার মা প্রায় সুস্থ, ক্ষত প্রায় শুকিয়ে গেছে। তবে মা-মেয়ের মানসিক অবস্থা আগের মতোই রয়ে গেছে—অদ্ভুত, অসম্পূর্ণ অথচ মমতায় পরিপূর্ণ।

সাংগঠনিক সম্পাদক, পঞ্চগড় বন্ধুসভা