অভাব-অনটনে কষ্ট করে মানুষ হয়েছি। তাই কি না, জানি না। বুঝতে শেখার পর থেকেই স্বপ্ন ছিল, লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করব। ভালো বেতন হবে, মা–বাবাকে নিয়ে আনন্দ করে বাঁচব।
পরিশ্রমে স্বপ্ন পূরণ হয়, পছন্দমতো চাকরি পাই। আনন্দে বাঁচার স্বপ্নে যুক্ত হয় বীণা। স্বপ্নের মতো করেই দিন অতিবাহিত হচ্ছিল। বিপত্তি শুরু হয় ট্রেনিং শেষে কর্মস্থলে ফেরার পর। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কয়েকজনের অন্যায় জোরাজুরিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তারপরও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে নারাজ। তখনো ফোনের যুগ শুরু হয়নি। মা-বাবা ও বীণার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। প্রতি সপ্তাহে একটি করে চিঠি লিখত বীণা। উত্তরে অল্প কথায় কয়েক লাইন আমিও লিখে পাঠাতাম; কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে ষড়যন্ত্র করে নারী কেলেঙ্কারিতে তারা আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়। ক্রমে পরিস্থিতি এতই জটিল হয়ে ওঠে যে বীণাকে চিঠি লেখা তো দূরে থাক, তার পাঠানো চিঠিও পড়ার সময় হয় না।
ভেবেছিলাম, ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি গিয়ে সব সংকটের কথা জানাব বীণাকে। চিঠিতে জানালে সবাই দুশ্চিন্তা করবে। এর মধ্যে এক দিন কি মনে হতে বীণার পাঠানো চিঠিগুলো নিয়ে বসি। বীণার হাতের লেখা সুন্দর। ওর চিঠি পড়লে আমার মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু প্রথম চিঠিটা পড়তেই বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা বোধ করি। বীণা লিখেছে, ‘তুমি সৎ-চরিত্রবান, ভালো ছেলে। এই বিশ্বাসের জোরেই তোমার হাতে বাবা আমাকে তুলে দিয়েছিলেন। সে কথা থাক, আমি পরের মেয়ে, আমার কথা না হয় না–ই ভাবলে; কিন্তু নিজের বাবা-মায়ের কথা ভেবে হলেও নিজেকে সংযত করো। একটা চিঠি এসেছে বাড়িতে। মা-বাবা ভেঙে পড়েছেন। দোহাই তোমার সামলাও নিজেকে। এক জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে নিতে পারব; কিন্তু স্বামীর চরিত্রে দাগ, স্বামী অসৎ। আজীবন এই কথা শুনে আর এক বুক অবিশ্বাস নিয়ে কেমন করে বাঁচব!’
কথাগুলো পড়তেই প্রকাণ্ড মেঘমালার মতো একরাশ অন্ধকার মাথায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিই, চাকরিটা ছেড়ে দেব। কিন্তু সিদ্ধান্ত খাতা-কলমে বাস্তবায়নের আগেই বীণা আমাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যায়। বীণাকে সব কিছু খুলে বলতে পারিনি। বলতে পারিনি, আমার কোনো দোষ ছিল না। আমি দুশ্চরিত্র নই। আমি কোনো অন্যায় করিনি।
কেশবপুর, যশোর