সাজেকের পথে–প্রান্তরে

রাঙামাটির সাজেকফাইল ছবি

পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সড়কগুলো সাপলুডুর মতোই উত্তেজনাকর। যেতে যেতে কখন না জানি গর্তে চলে যাই! সেই ভয়ে শরীর শিহরণ দিয়ে উঠছিল। রাতের অন্ধকারে শুধুই মোচড়ানোটা টের পাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস, নিচের গর্তগুলো চোখের আড়ালে ছিল।

আতঙ্ক আর প্রার্থনায়, যাত্রাবিরতি ঘোষণায় বাস থামল সমতলের এক রেস্তোরাঁয়। ক্ষুধায় পেটে আগুন ধরে আছে। টেবিলে বসেই খাবার অর্ডার করি। ব্যস ওই পর্যন্তই! পেটের রাজা মরে যায় যায়, তবু খাবার আসে না।

এই যাত্রায় আমাদের সঙ্গে আছেন মজার মানুষ মোহাম্মদ চাচা। পাশের টেবিল থেকে ধার করে দুটি পরোটা এনে পেটের জ্বালা মেটানোর কাজ সারলেন তিনি। আমি রেস্তোরাঁর কিচেনে গিয়ে আরও চারটা পরোটা এনে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

বিরতির পর বাস থামে আরও দু-একবার; তবে খাদ্য গ্রহণ নয়, নিবারণের জন্য। বাস গন্তব্যে পৌঁছার আগে তেমন আর স্মৃতি নেই। কারণ, ক্লান্তিতে চোখ বুঝেছিলাম বাকিটা পথ। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলাম, নাশতা করলাম খাগড়াছড়ির বিখ্যাত মনটানা রেস্তোরাঁয়। চাঁদের গাড়ি ভাড়া করলাম শেয়ারে। সাজেকগামী এই চাঁদের গাড়ির ধারণক্ষমতা ১৪ জনের, আর আসা-যাওয়ার ভাড়া ৭ হাজার ১০০ টাকা। আমরা সহযাত্রী ৬ জন। আসা-যাওয়ার পথে আরও ৮ জনের একটা টিমের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করলাম।

যদিও ফেরার পথে বুঝেছি, খরচ বেশি হলেও উচিত ছিল গাড়ি শেয়ার না করা। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক ভ্যালির দূরত্ব মাত্র ৭৫ কিলোমিটার। পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথ বেয়ে চাঁদের গাড়ি ছুটছে। চালক মণি সিংহ চাকমার মোবাইল স্পিকারে বাজছে গান, ‘আয় আয় চাঁদ, সোনার নূপুর পায়...’। বাতাসে দুচোখে স্নিগ্ধতা দিতে লাগল, হৃদয়টা রঙিন হয়ে উঠল সবুজরাঙা অরণ্যে। আবালবৃদ্ধবনিতা প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে বয়সকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে গলা ছেড়ে গাইলাম, ‘লাল পাহাড়ের দেশে চল...’, ‘শহর ছেড়ে দূরে...’, ‘পাহাড়ি মেয়ে...’সহ অসংখ্য গান। যেতে যেতে গাড়ি থামে আচমকা এক নির্জনে, খোঁজ পাই সামনেই কিছু পথ পেরোনো পাহাড়ের কান্না হাজারছড়া ঝরনা। কিছুটা কাদাপানি পেরিয়ে, উঁচু-নিচু টিলা অতিক্রম করে পাহাড়ের পাদদেশে খোঁজ মেলে অপরূপ নয়নাভিরাম ঝরনা। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে পা ভিজিয়ে সুখানুভূতিতে বেঁচে থাকার প্রার্থনায় নত হই রবের দরবারে।

সাজেকে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ফেরার তাড়ায় তাড়াহুড়াতেই ছেড়ে আসি এই জলধারা। আর্মির লোক নিয়ে রওনা হই সাজেকের উদ্দেশে।

ঘন সবুজ অরণ্যের মুগ্ধতায় পৌঁছে যাই স্বপ্নের চেয়ে বেশি সুন্দর করে সাজানো সাজেক ভ্যালিতে।

শহর ছেড়ে দূরে, সমতল থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উঁচুতে নিশ্বাস নিতে নিতে মন হারায় কল্পনায়, মন চায় থেকে যেতে এখানে। রিসোর্ট আলোতে থাকার বন্দোবস্ত করে, গোসল ও ঘুম শেষে বিকেলের স্নিগ্ধতায় দুচোখ মেলে যখন প্রকৃতি দেখি, মনে হয়, আহা, স্বর্গ বুঝি নামিল ধরায়। দুপুরে ঝালঝাল ঝোলে মুরগির মাংস আর পাহাড়ি বারোয়ারি তরকারি দিয়ে দরকারি খাবার গ্রহণ করে সমস্বরে সবাই বলেছিলাম, ‘আহা’।

সন্ধ্যা নামার আগেই উঠি সাজেকের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে। সমতল থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট ওপরে উঠে শুধু ছবিই তুলিনি; পাহাড়ি জাম্বুরা, কলা, ডাব খেতেও ভুলিনি। যখন সূর্য ডুবি ডুবি, আমরাও চুপিচুপি উঠে বসি হ্যালিপ্যাডের চূড়ায়। আড্ডা, গান, মাস্তিতে রিসোর্টে ফিরে আসি রাতে।

আহ বারবিকিউ, বাহ বারবিকিউ। রিসোর্টে বারবিকিউ শেষে ক্লান্ত দেহে অবারিত নীলাভ আকাশের তারা গুনে গুনে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভেঙে দেখি, জান্নাতি ভোর এল জীবনে, হাজার শোকরিয়া খোদার দরবারে। যেন মাত্রই দেখলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সকাল। মেঘগুলো জমে আছে পায়ের নিচে, মেঘের ওপর বসত আমাদের। এ যেন স্বপ্নে দেখা রূপকথার সোনালি সকাল।

নাশতার তাড়া নেই, প্রকৃতির মুগ্ধতায় যেন ক্ষুধা হয়েছে হাওয়া। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সঙ্গী হিসেবে মণি সিংহ আর বাহন হিসেবে চাঁদের গাড়ি। দেখতে দেখতে সময় ফুরায়। মণি সিংহ ফেরার তাড়া দেখায়। সাঈদ মামা, আসাদ মামা, মোহাম্মদ চাচা ফিরতে চান না।

জুয়েল ভাই, মীর হোসেন ভাই আরও কদিন থাকতে চান। আমার তো মরতেও নেই দ্বিধা এই সুন্দরতম স্থানে! কিন্তু এখানে এক দিনের বেশি থাকতে হলেও লাগে আর্মির পূর্বানুমতি।

আফসোসে আফসোসে ডাবল ডিম দিয়ে খাই ভুনা খিচুড়ি। কিছুক্ষণ আগে ইন্দ্রজিতের বাগান থেকে সংগ্রহ করেছিলাম সবুজ সতেজ লেবু, তারই রস আস্বাদন করে, মনে চাপা অতৃপ্তি আর শিগগিরই আবার পদচারণের আশা ব্যক্ত করে যেভাবে এসেছিলাম, সেভাবেই ফিরে আসি যান্ত্রিক, তবু প্রাণের শহর ঢাকায়।

আমাদের নাড়ির টান, শিকড়ের ঘ্রাণ তো এখানেই। একটা সফল ভ্রমণ শেষে ‘মা’ বলে ডাকতেই দরজা খুলে জড়িয়ে ধরেন জননী। যেন কত কাল পর দেখি মায়ের মুখ। জীবন এত সুন্দর কেন! প্রতিটি ভ্রমণ শেষে অভিন্ন সুখানুভূতি।

সভাপতি (২০২৩), কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা