আমাদের পরিচয়

কর্ণফুলী নদীতে সাম্পান বাইচ।ছবি: সৌরভ দাশ

‘বাঙালি কী খায়?’ প্রশ্নটা মোটেই সহজ নয়, উত্তর তো আরও নয়। বইপোকা যে কেউ বলে দিতে পারবে, ‘আমরা বাঙালিরা তো মাছে-ভাতে বাঙালি।’

সারা জীবন সেটাই শুনে এসেছি আমরা। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের কথা বললেই আমরা মাছ আর ভাতের কথা বলি। আর সত্যিই তো, অসংখ্য হাওর-বাঁওড়, নদী-পুকুরে ঘেরা এ দেশের মানুষ মোটা চালের ভাত আর মাছ পেলে আর কিছু চায় না। অবশ্য যদি বলা হয়, মাছ কেনার সাধ্য কি সবার আছে? অনেকেই আছেন, যাঁরা একটা কাঁচা মরিচ আর লবণ দিয়ে দুই-তিন থালা ভাত সাবাড় করে দিতে পারেন নিমেষে। তুলতে পারেন তৃপ্তির ঢেকুর। বলতে পারেন, আহা! আজকের পান্তাভাতটা দারুণ লাগল খেতে।

খুব ভালো কথা। কিন্তু আমরা এবার একটু আমাদের নিজেদের দিকে তাকাই। খাদ্যাভ্যাসে কি পরিবর্তন ঘটছে না? শহুরে বাঙালিরা কি খুব দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে না ফাস্ট ফুডে কিংবা বিদেশি খাবারে?

আশির দশকে আমরা যখন সদ্য তরুণ, তখন বন্ধুরা মিলে খেতে গেলে শিঙাড়া, সমুচা আর চায়ের বেশি কিছু ছিল না। জন্মদিনের খাবার ছিল চানাচুর, বিস্কুট, মিষ্টি আর কখনোসখনো কেক। আর এখন? মাছ-ভাত খাওয়ার চেয়ে একটা বার্গার, একটু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিংবা চীনা খাবারের দিকেই পক্ষপাত। ইদানীং তো দক্ষিণ ভারতীয় খাবার কিংবা মেক্সিকান খাবারের দিকেও ঝোঁক দেখা যাচ্ছে।

বাড়ির রাঁধুনিরাও সে রান্না শিখে ফেলছেন অনায়াসে। দাওয়াত করেও খাওয়াচ্ছেন অন্যদের। বলছেন, ‘স্যুপটা কিন্তু আমি নিজ হাতে করেছি। নিউমার্কেট থেকে অমুক পাতা কিনতে আমার তিন ঘণ্টা লেগেছে।’ আবার খাবারদাবারের উৎসবও বানানো হচ্ছে নতুন করে। মূলত হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান এখন দুই-তিন-চার-পাঁচ থেকে সাত দিনে গিয়েও ঠেকেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানের খাওয়া তো বটেই, গায়েহলুদের অনুষ্ঠানেও খাওয়াদাওয়ায় রয়েছে বাদশাহি আমেজ। অর্থাৎ বিবাহসংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলোয় দেদার খরচ করার প্রণবতা ঢুকে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা তো ঐতিহ্যের অংশ। আসলেই কি তা-ই? বিশ বছর আগেও গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে বিরিয়ানি বা তেহারি খাওয়ার ঐতিহ্য কি ছিল আমাদের? তাহলে কি আমাদের এত দিন ধরে টিকে থাকা ঐতিহ্য একটু হুমকির মুখে পড়ল?

খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কথা বলার সময় একটা কথা কিন্তু মনে রাখা দরকার। স্থানীয়ভাবে যা রান্না হতো এ দেশে, তা কিন্তু মুসলিম শাসকেরা পছন্দ করতেন না। তাঁরা খেতেন ভিন্ন ধারার রান্না করা খাবার। এসব খাবারই পরে মোগলাই খাবার বলে পরিচিতি পেয়েছে। এ ছিল রাজরাজড়াদের খাবার। সাধারণ মানুষ এর স্বাদ পেত না। শুধু বাদশাহ বা নবাবদের প্রাসাদে দাওয়াত থাকলেই কেবল এই খাবারের স্বাদ পাওয়া যেত। পরে ক্ষয়িষ্ণু নবাব পরিবারগুলোর বাবুর্চিরা বেরিয়ে এসে শহরে হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলায় মোগলাই খাবার উঠে এসেছে সাধারণ বাঙালির রসনায়।

তার মানে, এখন আমরা যেসব খাবারকে আমাদের ঐতিহ্য বলে মনে করছি, তার অনেকগুলোই আগে এ অঞ্চলের খাবার ছিল না। কিন্তু দীর্ঘদিন সে অভ্যাসকে চালু রাখায় পরে তা বরণ করে নেওয়া হয়েছে। এখন বিরিয়ানি, কোপ্তা, কাবাব আমাদের খাবার নয়, এ কথা বললে মানুষ হাসবে। তাই স্যুপ কিংবা বার্গার কখনো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যাবে কি না, সে বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত দেওয়ার কিছু নেই। আমার শুধু মনে হয়, বিশ্বায়নের যুগে প্রতিটি জাতির স্বকীয়তা বেঁচে থাকবে প্রত্যক্ষ লালনের মাধ্যমে। বারোয়ারি মানুষ ভেসে যাবে নতুন বৈচিত্র্যময় সহজলভ্য নতুন সংস্কৃতির জোয়ারে।

বাঙালি খাবারে এসেছে নানা পরিবর্তন

সংস্কৃতি

আমি একবার রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সংস্কৃতি মানে কী? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন এককথায়—সংস্কৃতি হলো আরও একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা।

‘সংস্কৃতি’ শব্দটা উচ্চারণ করলেই যেসব ছবি চোখের সামনে ভাসে, তা হলো, ভাষা, গান, নাচ, নাটক, সিনেমা, চিত্রকলা, মানে চারু ও কারুকলার সবকিছু, খাওয়াদাওয়া, পোশাক ইত্যাদি। অর্থাৎ একটি জাতির মানুষ কীভাবে অন্য জাতি থেকে আলাদা, সেটা বোঝা যায় তাঁর সংস্কৃতি দিয়ে। অতীতে যত সহজে সংস্কৃতি দিয়ে জাতি চেনা যেত, এখন ঠিক ততটা সহজ নয়। কারণ, বিশ্বায়নের ভালো-মন্দ নানা কিছুই অবলীলায় এখন ঢুকে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে। পুরোনো মূল্যবোধ হয় ধসে যাচ্ছে অথবা পরিবর্তিত হচ্ছে। বলা যায়, একটা বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা, নতুন করে তৈরি হচ্ছে সম্পর্ক। সংস্কৃতির ভিতটা টিকে থাকছে গ্রামীণ সমাজে কিছুটা, কিছুটা শহুরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিছু টিকে থাকছে এমনিতেই।

যেমন নববর্ষ। এখন বাংলা নববর্ষের উৎসব বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব। শহরে–গ্রামে প্রত্যেক মানুষের প্রাণে দিনটি স্থান করে নিয়েছে। একসময় কিন্তু নববর্ষের এত ব্যাপকতা ছিল না। হ্যাঁ, হালখাতা হতো, মেলা হতো, ঘোড়দৌড় হতো, বাজারে মিষ্টিমুখ করানোর প্রচলন ছিল। কিন্তু এখন যেমন প্রত্যেক মানুষ নেমে যান রাস্তায়, সেটা বুঝি ছিল না তখন। বাংলা নববর্ষ এখন নিয়েছে অসাধারণ এক উৎসবের রূপ। রমনা বটমূলে ছায়ানট যে বৈশাখী অনুষ্ঠান শুরু করেছিল, তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। নববর্ষ আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ। এটা যে পরিবর্তিত হচ্ছে না, তা নয়। তবু বলা যায়, সে পরিবর্তন নববর্ষ থেকে বাঙালিত্ব কিংবা এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী অন্য জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়কে ধ্বংস করে দেয়নি।

বাংলা নববর্ষের উৎসব বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব
ছবি: লিমন

ভাষায়, গানে

বেশি গভীরে যাব না। বাংলা যে সংস্কৃত ভাষার দুহিতা নয়, সেটা এরই মধ্যে প্রমাণিত। বৈদিক ভাষা যখন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গিয়ে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মধ্যে ভাবপ্রকাশে সমস্যার সৃষ্টি করল, তখন সে ভাষা সংস্কারের দরকার হয়ে পড়ল। সেই কাজই করলেন পাণিনি, খ্রিষ্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে। সেটাই সংস্কৃত। এ এক মৃত ভাষা। কারণ, এর মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। যা যেমন ছিল, তা তেমনই থাকবে আজীবন।

বৈদিক ভাষার পাশাপাশি স্থানীয় ভাষা বিকশিত হয়েছে। প্রাকৃত ভাষা অপভ্রংশ হয়ে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলোর জন্ম। এই ভাষা পরিবর্তিত হয়, নতুন নতুন শব্দকে গ্রহণ করে। বাংলা ভাষা তত দিন টিকবে, যত দিন পর্যন্ত এই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করা যাবে, যত দিন পর্যন্ত নতুন নতুন শব্দ যুক্ত হবে ভাষায়।

এই ভাষার মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের শুরু। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কার করলেন চর্যাপদ। এটি বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। বাংলা ভাষায় এর আগের কালের আর কিছু পাওয়া যায়নি। মনে করা হয়, ৯৫০ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যে লেখা হয়েছে চর্যাপদ। এরপর বড় একটা সময়জুড়েই ছিল ‘বৈষ্ণব পদাবলি’। ১৩৫০ থেকে প্রায় ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলেছে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ। এ সময় ‘বৈষ্ণব পদাবলি’র পাশাপাশি ‘মঙ্গলকাব্য’ বিকশিত হয়েছে। আধুনিক যুগ আসার আগে এগুলোই ছড়িয়েছে কাব্যের সুষমা।

আর গানের কথা বললে, গ্রামীণ সহজিয়া জীবন থেকে উঠে আসা সুরগুলোই বাঙালির নাড়ির সুর। অন্য আলাপে যাওয়ার আগে আমরা লালন ফকিরের কথা বলতে পারি। আনুমানিক ১৭৭৪ সালে তাঁর জন্ম। তিনি মারা গেছেন ১৮৯০ সালে। এত সরলভাবে জীবনের গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে কথা বলেন তিনি, যা শুনলেই বিশ্বজগতের বিস্ময় নিয়ে ভাবাক্রান্ত হয় মন। আর রয়েছে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া। রয়েছে কবিগান, জারিগান। হাজার বছর ধরে মানুষ বেড়ে উঠেছে এসব গানের সুরে সুরে।

ভাষার মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের শুরু
ফাইল ছবি

সাহিত্যের শুরু থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত প্রায় সব রচনাই ছিল ঈশ্বরমুখী। মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দুধর্মীয় সাহিত্য ছিল এর মধ্যে। কিন্তু তারই মধ্যে ঢুকে গেছে রোমান্টিক কথকতা। কিন্তু বলতে হবে, উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত বাঙালি তার মনের কথা প্রকাশ করেনি বললেই চলে। বৈষ্ণবকাব্যের প্রেম তো রাধা-কৃষ্ণের আলোয় আলোকিত।

হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বে পড়ে মধ্যযুগ থেকেই তো বাঙালি জাতির মধ্যে দুটো ভিন্ন ধারা পরিপুষ্ট হতে থাকে। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের নিরলস প্রচেষ্টায় একটা সমন্বয়বাদী ধারারও সৃষ্টি হয়। উনিশ শতকে শিক্ষিত বাঙালি ইংরেজদের প্রভাবে ইউরোপীয় মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচিত হয়। এ সময় থেকেই মানবতা, ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটতে থাকে সাহিত্যে। সাহিত্যের মূল বিষয় হয়ে ওঠে মানুষ। অনেকটা রেনেসাঁর মতো। এ সময় মুদ্রণযন্ত্রের বিকাশের ফলে মুখে মুখে চলে আসা সাহিত্য বিপদগ্রস্ত হয়। সেই ধারা ক্রমেই ক্ষীয়মাণ হতে থাকে।

সেই যে বৈষ্ণবকাব্যগুলো রচিত হয়েছিল, তার সবই কিন্তু ছিল গান। উনিশ শতকের গোড়ায় কিন্তু ছড়িয়ে পড়ে টপ্পা, আখড়াই ও বাংলা ধ্রুপদ। এ সময় ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্রও আসতে শুরু করে বাংলায়। বেহালা, অর্গান, হারমোনিয়াম। বিংশ শতাব্দীতে বাংলা বাদ্যযন্ত্রীদের দেখা যায়। আলাউদ্দীন খাঁ, আলী আকবর খাঁ, রবিশঙ্করের মতো বিশ্বমাপের বাদ্যযন্ত্রশিল্পীর জন্ম হয় এ সময়। ছিল রাগপ্রধান গান। তবে সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয় আধুনিক গান। আধুনিক গান আসলে আর কিছু নয়, এটি রাগসংগীত, লোকসংগীত ও পশ্চিমা সংগীতের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গান। রবীন্দ্রনাথের গানও তো একসময় ছিল আধুনিক গান। ছিল নজরুলের, অতুলপ্রসাদের, ডি এল রায়ের গানও। এখন যেসব গান হচ্ছে, তা সেই ধারাকেই বিকশিত করে চলেছে। কিন্তু এর মধ্যে পশ্চিম থেকে এসেছে পপ-রক গান। কখনো হিপহপ, কখনো র‍্যাপও চেষ্টা করছে আমাদের সংগীতে জায়গা করে নিতে। আজম খানের নেতৃত্বে যে পপ-রক ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, তা কিন্তু টিকে গেছে। আমাদের দেশে ব্যান্ড সংগীতের ভক্তের সংখ্যা কম নয়। একই সঙ্গে ক্ল্যাসিক্যাল, রবীন্দ্র-নজরুল ও রক ভালোবাসা যাবে না, এমন মাথার দিব্যি মনে হয় কেউ দেয়নি। আনন্দ পাচ্ছি কি না এবং সেই আনন্দে লোকজ উপাদানটি রয়েছে কি না, সেটাই হয়তো বিবেচনার মুখ্য বিষয় হতে পারে।
ঠিক আছে, অনেক কথা বলা হলো, অনেক কথাই বলা হলো না। মোটামুটি সংস্কৃতির কয়েকটি দিকের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করা গেছে, তাতে আলোচনাটা একটু গুরুগম্ভীর হয়ে উঠেছে। সেখান থেকে একটু বেরিয়ে যাই আমরা, দেখি আশপাশে কী ঘটছে।

পোশাকে

পুরো নবাবি আমল, পুরো ব্রিটিশ আমল বাঙালি নারীর পোশাক পাল্টাতে পারেনি। কিন্তু এই যে আকাশ সংস্কৃতির পথ ধরে ভারতের সালোয়ার-কামিজ সংস্কৃতি এখন কিন্তু পিছু হটে গেছে। একটা সময় জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশে। শাড়িই ছিল মূল পোশাক। এখন শহরাঞ্চলে, কোথাও কোথাও গ্রামাঞ্চলেও শাড়ির জায়গা করে নিয়েছে সালোয়ার-কামিজ। আর পুরুষদের শার্ট-প্যান্ট তো ব্রিটিশদেরই অবদান। লুঙ্গি, ধুতি, পায়জামা এখন ঘরের পোশাকে পরিণত হয়েছে। পোশাকের নব নব পরিবর্তন হচ্ছে মূলত ইউরোপীয় আদলে অথবা হিন্দি সংস্কৃতির প্ররোচনায়।

হিন্দি সিরিয়াল দেখে কোনো কোনো উৎসবও বানাচ্ছে নতুন যুগের বাঙালি। পোশাক পরছে তাদের আদলে। এমনকি ভারতীয় হিন্দি বা বাংলা ধারাবাহিকে নায়িকার পরা পোশাক বেশি বিক্রি হচ্ছে ঈদের সময়। ‘পাখি’ নামক এক পোশাক কিনে না দেওয়ায় স্বামীর প্রতি অভিমান করে আত্মহত্যা করেছেন গৃহবধূ—এ রকম ঘটনাও ঘটেছে। অর্থাৎ আমাদের পোশাক সংস্কৃতিতে এখন হিন্দি সিরিয়ালের ঝোঁক চলছে, এ কথা বুঝি জোর দিয়ে বলা যায়। কিন্তু নিজ সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাস রেখে নিজেদের সুতায়, নিজেদের তৈরি কাপড়ে পসরা সাজাচ্ছেন কিছু পোশাক প্রস্তুতকারী, এ কথাও মনে করিয়ে দিতে হয়। এ কারণেই পাঞ্জাবি, ফতুয়া উঠে আসছে পুরুষদের শরীরে।
সত্তরের দশকে এমনকি আশির দশকেও সাদা রং ছাড়া পাঞ্জাবি হতো না। অন্য রঙের পাঞ্জাবি যে বানানো যেতে পারে, সেই ভাবনাই ছিল না। কিন্তু পাঞ্জাবি এখন বর্ণিল হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন উৎসবে পুরুষের পোশাকে পাঞ্জাবির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। উৎসবে পাঞ্জাবি-পায়জামা, শাড়ি পরার প্রচলন এখনো আছে।

বাঙালির পরিচয়

আরেকটি বিষয়ে কথা বলে বহুল পরিচিত বাঙালির চারিত্রিক কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলছি। বাঙালির চরিত্রের একটা বড় দিক হলো, একা একা সে অনেক কিছুই করতে পারে। দুজন হলে তাঁর কাজে একটু শৈথিল্য আসে। বহুজনে মিলে বাঙালি শুধু ভাঙতে জানে, গড়তে জানে না। এটা বাঙালি সম্পর্কে বহু বছর ধরে বলা হয়। সাধারণত বাঙালি আয়েশি। ঢিলেঢালা জীবনযাপনই তার পছন্দ। হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকার পর হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে, তারপর আবার ঘুমায়। গত শতাব্দীতেই দুবার বাঙালি জেগে উঠেছিল, একবার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছে, একবার স্বাধীনতা এনেছে। তারপর আবার দিয়েছে ঘুম। সে ঘুম আর ভাঙছে না। বাঙালির একটা বড় অংশই হুজুগে। দীর্ঘ মেয়াদে ফলাফলের কথা না ভেবেই সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনো কাজে। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হয়। এখনো পারিবারিক বন্ধনের প্রতি শ্রদ্ধা আছে বাঙালির। ফেসবুক-মুঠোফোনের যুগে সে বন্ধন কিছুটা শিথিল হওয়ার লক্ষণও দৃশ্যমান। পুঁজিবাদের পথে এগিয়ে চলেছে বলে হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠা মানুষ নিজেকে জাহির করার সুযোগ ছাড়ে না। মধ্যবিত্ত ও ধনীদের মধ্যে উচ্চে ওঠার প্রতিযোগিতা চলছে দৃষ্টিকটুভাবেই। সেই অরুচিকর প্রতিযোগিতাও এ মুহূর্তে আমাদের সংস্কৃতির অংশ।

আমাদের একটা পরিচয় আছে। সে পরিচয় হাজার বছরের ঐতিহ্যনির্ভর। নতুন যুগে তা ভেঙে পড়ছে। যোজন-বিয়োজনে কী টিকে থাকবে আর কী থাকবে না, সেটা এখনই বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে নিজ ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে নতুনকে বরণ করে নেওয়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই যেন করি আমরা। আমরা যেন বিদেশিদের অন্ধ অনুকরণ না করি, বিপরীতে নিজের অর্জন নিয়ে অহংকার করে অন্য সংস্কৃতির প্রবেশের পথ রোধ না করে দিই। মিলেমিশে গ্রহণ-বর্জনেই টিকে থাকে ঋদ্ধ সংস্কৃতি।

তাহলে যা বলার ছিল...

নিজের সংস্কৃতিটা হচ্ছে শিকড়। সেই শিকড়কে অগ্রাহ্য করলে বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। পরগাছা কখনো গাছ হয় না। ঋদ্ধ সংস্কৃতিই মানুষের মনকে বিনয়ী, বন্ধুবৎসল ও আনন্দময় করে তুলতে পারে। সংস্কৃতির শিকড়ের ওপর যে ডালপালার জন্ম হয়, তা–ও তখন হয় সুচারু, নান্দনিক। কিন্তু বিদেশের অন্ধ অনুকরণ করলে সেটা মানুষের আত্মপরিচয়কেই ধ্বংস করে দেয়। তখন সে পরগাছাতেই পরিণত হয়। আবার বাইরের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নতুন করে নিজের সংস্কৃতিকেও ঋদ্ধ করা যায়।

তাই, ভারতীয় সিরিয়াল বলি আর পশ্চিমা সংগীত বলি, আফ্রিকান র‍্যাপ বলি আর হিপি আন্দোলন বলি, যার সঙ্গেই পরিচিত হব আমরা, তা থেকে যাচাই-বাছাই করেই কিছু না কিছু গ্রহণ করব। কোনো কোনোটা মিশে যাবে আমাদের সংস্কৃতিতে, কিছু বিষয় মিলবে না। গ্রহণে, বর্জনেই ভিত পাবে সংস্কৃতি। লোকজ সংস্কৃতির গাঢ়তা বুকে নিয়ে বিদেশ–বিভুঁইয়ের সংস্কৃতির খোঁজে যেতে হয়। নইলে তা সংস্কৃতিহীনতার মতো হীনম্মন্যতারই জন্ম দেয়।

এবার তুমিই ভেবে দেখো, নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় শিকড়ের ওপর দাঁড়াবে নাকি ভেসে যাবে পরসংস্কৃতির জোয়ারে? উত্তরটা অন্য কেউ দিয়ে দেবে না, খুঁজে বের করতে হবে তোমাকেই!

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘লেখার ইশকুল’, প্রথম সংখ্যা, জুন ২০১৬ থেকে নেওয়া।