মাসউদ আহমাদের কলমে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনীসাহিত্য

অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনসংগ্রামকে উপজীব্য করে মাসউদ আহমাদের লেখা উপন্যাস ‘তিতাসের বুনো হাঁস’ সংক্ষিপ্ত আকারে প্রথম আলোর ঈদসংখ্যা ২০২৪-এ ‘তিতাসপুত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়ছবি: সংগৃহীত
উপন্যাসটি শুধু খ্যাতিমান লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনসংগ্রামের কথাই জানায় না, একই সঙ্গে মালোপাড়ার মানুষের জীবন-জীবিকা, এ দেশের গ্রামীণ ও লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কেও ধারণা দেয়।

তিতাস মেঘনার একটি শাখানদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গোকর্ণঘাট গ্রামে ছোট্ট এই নদের তীরেই মালো সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করা এবং বেড়ে ওঠা এক যুবক মাত্র একটি উপন্যাস লিখেই বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি বহন করা আজন্ম পরিচিত এই নদীবিধৌত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনের চিরায়ত সংগ্রাম কলমের খোঁচায় তুলে এনে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামে সমৃদ্ধ করেছেন সাহিত্যজ্ঞান। বলছি বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের কথা। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনসংগ্রামকে উপজীব্য করে এ সময়ের লেখক মাসউদ আহমাদ লিখেছেন উপন্যাস ‘তিতাসের বুনো হাঁস’। এটি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রথম আলোর ঈদসংখ্যা ২০২৪-এ ‘তিতাসপুত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যাটি হাতে পেয়েছি বেশ কয়েক মাস হলো। পুরোটা পড়া হয়ে না উঠলেও ফাঁকফোকরে বেশ কয়েকটি কবিতা ও ছোটগল্প পড়া হয়েছে। সেদিন রাতে কী ভেবে জানি চোখ বোলাচ্ছিলাম, হঠাৎ ‘তিতাসপুত্র’ শিরোনামটি নজর কাড়ল। তৎক্ষণাৎ পড়া শুরু। প্রথমে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও তিতাস নদের নাম দেখে মনে খটকা লাগলেও তা দূর হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই নিশ্চিত হয়েছি যে উপন্যাসের আদলে এখানে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনসংগ্রামই উপস্থাপিত হয়েছে।

ছেলে বা মেয়ে, পড়াশোনা ও চাকরির কোনো ধারা নেই মালোপাড়ায়। বংশপরম্পরায় এখানকার সবাই জেলে। এসব ছেলে-মেয়ের মতোই তিতাসের জল-কাদা, নৌকায় ঘুরে বেড়ানো ও ডাঙার ধুলাবালুতে অদ্বৈতেরও বেড়ে ওঠা। প্রথা ভাঙার যাত্রাটা শুরু হয় শৈশবেই। মালোপাড়ার অবহেলিত এবং প্রায় অবাঞ্ছিত জনপদ থেকে প্রথম স্কুলের পথে হাঁটতে শুরু করে মা–বাবা–হারা অনাথ ছেলে অদ্বৈত। তার জীবনে পথনির্দেশক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আবির্ভূত হয় সনাতন মাস্টার। ক্রমান্বয়ে মালো সম্প্রদায়ের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় তাকে ঘিরে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আইএ পড়াকালীন একবার বাড়িতে এলে অন্য সবার সঙ্গে যখন অদ্বৈত কাজে হাত লাগাতে যায়, তখন একজন বাধা দিয়ে বলে ওঠে, ‘পড়ালেখা করে তুমি অনেক বড় হবা। একদিন সত্যি সত্যি তুমি আমাদের পাশে দাঁড়াবা। লোকেরা আমাদের যেন ঠকাতে না পারে। কূটচাল করে মারতে না পারে।’ নীতীশ বলল, ‘কিশোর ঠিকই কইছে, অদোদা।’ কিশোর বলে, ‘মহাজনেরা মাছের ন্যায্যমূল্য নিয়ে নিত্যি প্রতারণা করে। আর য্যান না করতি পারে। আমরা তো সেদিনের অপেক্ষাত আছি রে অদোদা।’ চারপাশের মানুষের এত প্রত্যাশা অদ্বৈতের মনেও দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে। এই সম্প্রদায়ের, এই জনপদের মানুষের জন্য কিছু একটা করবার সূক্ষ্ম বাসনার জন্ম হয় তার মানসপটে।

শুধু যাবতীয় সংকট অতিক্রম করে পড়াশোনাই নয়, মালোপাড়ার প্রকৃতি আর তিতাসপাড়ের জল-হাওয়া অদ্বৈতকে করেছে ভাবুক ও অনুসন্ধানী। এর থেকে সূচনা হয় লেখালেখির। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জর্জ স্কুলের সাহিত্য পত্রিকা ‘সবুজ’-এ নিয়ম অনুযায়ী শুধু ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের লেখা প্রকাশিত হওয়ার কথা থাকলেও স্কুলের শিক্ষার্থী না হওয়া সত্ত্বেও অদ্বৈতর লেখা সবুজে প্রকাশিত এবং ব্যাপক প্রশংসিত হয়। তীব্র সাহিত্যানুরাগ আর প্রচেষ্টাই তাকে এ অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ার সুবাদে জর্জ স্কুলের শিক্ষার্থী অনুজ মতিউল যখন নিঃসংকোচে অদ্বৈতর কাছে পাণ্ডুলিপি পড়তে দেয়, অদ্বৈত ভাবে, ‘কবিতা লেখার কাজ এক দূরগামী যাত্রা। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপন এবং জীবনের কর্মকাণ্ডের বিচিত্র পরিক্রমা’। অতঃপর একটি চিঠিতে অদ্বৈত মতিউলকে তার কবিতার পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে মূল্যায়ন ব্যক্ত করে। এ যেন চিঠির আদলে পাঠকের কাব্য সম্পর্কে আদ্যোপান্ত পাঠ হয়ে যায়।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনসংগ্রামকে উপজীব্য করে এ সময়ের লেখক মাসউদ আহমাদ লিখেছেন উপন্যাস ‘তিতাসের বুনো হাঁস’
সংগৃহীত

কুমিল্লা শহরে কল্পনা রায় ও সুশীল রায় দম্পতির বাড়িতে জায়গির থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। কল্পনা দে রায় ছিলেন প্রতিবাদী ও অধিকারসচেতন নারী। যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। বিপরীতে তাঁর স্বামী সুশীল দে রায় ছিলেন একেবারে উল্টোধাঁচের মানুষ। মেয়েদের পুরোদস্তুর ঘর–সংসারে ন্যস্ত না থেকে দেশ রক্ষার কাজে বেড়িয়ে পড়া মোটেও মেনে নিতে পারতেন না তিনি। কল্পনা এসবে তোয়াক্কা করেন না। কারণ, প্রতিবাদ ও বিপ্লব মানুষকে সাহসী ও অকুতোভয় করে তোলে। এ নিয়ে তাঁদের মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংকট চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। একপর্যায়ে কল্পনা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অদ্বৈতর জীবনে। শহরে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হয় তাঁকে। ফিরে আসতে হয় নিজভূমে, তিতাসপাড়ে। এরই মধ্যে কলকাতায় একটা পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হন বারবার। পড়াশোনাটা থমকে যায় ঠিকই, তবে নতুন কর্মময় জীবনের হাতছানিও উপেক্ষা করার সাধ্য থাকে না। অতঃপর সব পিছুটানের অবসান ঘটিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে ট্রেনে চেপে বসা।

উপন্যাসটিতে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনসংগ্রামের পাশাপাশি আরও উঠে এসেছে এ দেশের একেবারে তৃণমূল জনপদের মানুষের বিভেদহীনতা ও সম্প্রতির বন্ধন। যেমন গোকর্ণঘাটে মালোদের পাশাপাশি মুসলমান কৃষকেরাও বাস করেন, তিতাসের জলে মাছ ধরেন। তাঁদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। তাঁদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়। আবার প্রচলিত ধ্যানধারণার বেড়াজাল ছিঁড়ে সামাজিক সংকট থেকে উত্তরণের গল্প। কাহিনিপরম্পরায় বর্ণিত হয়েছে লোকজ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের কথা। এসবের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ঢেঁকি, বিবাহ–অনুষ্ঠান, লোকাচার, গ্রামীণ মেলা ইত্যাদি।

উপন্যাসটি শুধু খ্যাতিমান লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনসংগ্রামের কথাই জানায় না, একই সঙ্গে মালোপাড়ার মানুষের জীবন-জীবিকা, এ দেশের গ্রামীণ ও লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কেও ধারণা দেয়। পাতায় পাতায় অজান্তেই যেন ভাবুক পাঠকের হৃদয় হারিয়ে যায় সেই সময়ে, সেই সব দৃশ্যপটে। সব মিলিয়ে উপন্যাসটি বেশ সুখপাঠ্য।

গত বছর অক্টোবরে ‘তিতাসপুত্র’ শিরোনামে সংক্ষিপ্ত আকারে উপন্যাসটি পড়েছিলাম এবং এই পাঠানুভূতিও সে সময়ই লেখা। এবারের বইমেলায় ‘তিতাসের বুনো হাঁস’ শিরোনামে ‘প্রথমা’ প্রকাশন থেকে উপন্যাসটি বর্ধিত সংস্করণে বের হওয়ার সংবাদ আনন্দ দিচ্ছে। যেখানে ক্ষণজন্মা এই লেখকের ৩৭ বছরের জীবনকালের সংগ্রামকে খুব গভীর ও সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করুক।

রাজারহাট, কুড়িগ্রাম