শান্ত শহরের মধ্য দিয়ে নীরবে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। চিত্রা নদীর ওপর আঁকাবাঁকা সাপের মতো সেতুটি দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। নড়াইলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কালীগঙ্গা, মধুমতী, নবগঙ্গা, নলিয়া, আর্বারোবকি ও ঘোড়াখালী নদী। শহরের লোকজন রূপগঞ্জ বাজারের ঘাট দিয়ে নৌকাযোগে এপার থেকে ওপারে আসা-যাওয়া করেন। নদীর ঘোলাটে পানিতে প্রচুর কচুরিপানা ও শেওলা ভেসে বেড়ায়। গোধূলিবেলায় অন্ধকারে চিত্রা নদীর পাড়ে জোনাকি আর ঝিঁঝি পোকারা ছোটাছুটি করে। মাঝেমধ্যে শ্যালোচালিত বোটের ভটভট শব্দ কানে ভেসে আসে।
নড়াইলে অনেক গুণীজনের জন্ম। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর ও সুরকার কমল দাশ গুপ্তের পৈতৃক বাড়ি, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের বাসভবন এবং দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়িও এ শহরে। তবে নড়াইলকে মানুষ চিনে আরও একজন মানুষের কারণে, চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। গুণী এ শিল্পীর জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল জেলার মাছিমদিয়ার এক কৃষক পরিবারে। তাঁর পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তবে পরিবারের সবাই তাঁকে লাল মিয়া বলে ডাকত।
ছবি আঁকা শুরু
১৯২৮ সালের কথা, এস এম সুলতানের দরিদ্র পিতা শেখ মেসের আলী তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখানে পাঁচ বছর পেরোতে না পেরোতে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। স্কুল ছাড়ার পর মাঠে, খামারে, আবার কখনো রাজমিস্ত্রির কাজে বাবাকে সাহায্য করতেন এস এম সুলতান। রাজমিস্ত্রির কাজ করার সময় তুলির আঁচড় দিয়ে বিভিন্ন দালানে ছবি আঁকা ও নকশা করে বেড়াতেন তিনি।
একদিন স্কুল পরিদর্শনে আসেন ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। সে সময় ১০ বছরের বালক এস এম সুলতানের আঁকা ছবি দেখ মুগ্ধ হন তিনি। তাঁর ইচ্ছে ছিল কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা শেখা। নড়াইলের লোহাগড়ার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ও তাঁর প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। ১৯৩৮ সালের দিকে এস এম সুলতান কলকতায় চলে যান ও ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের কলকাতার বাসায় ওঠেন। দরিদ্র শিল্পীর ইচ্ছে ছিল অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি ছবি আঁকা শেখা। একসময় তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে পড়ালেখা শেষ করে তিনি ফ্রিল্যান্স শিল্পীর জীবন শুরু করেন।
বাউন্ডুলে জীবন
এস এম সুলতানের মাথাভর্তি পাখির বাসার মতো লম্বা চুল। চলাফেরা বেশভূষা ছিল বাঙালি নারীদের মতো। শাড়ি পরতেন, পায়ে নূপুর, গলায় মালা দিয়ে নাচতেন। স্বাধীনচেতা বাউন্ডুলে প্রকৃতির। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রীতিনীতিও মেনে চলতেন না। প্রকৃতির প্রতি তাঁর আলাদা টান ছিল। শিল্পীর সংগ্রহশালার আঙিনা নানা রকম গাছগাছালি আর ফুল-ফল ও লতাপাতায় পরিপূর্ণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন এস এম সুলতান। উপমহাদেশের বিভিন্ন শহরের অলিগলিতে ইংরেজ ও মার্কিন সৈন্যদের ছবি আঁকতেন। রণক্ষেত্র, বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক ও গ্রামবাংলার ছবি প্রদর্শনী এবং বিক্রি করে চলত তাঁর জীবন। ভারতের সিমলায় ১৯৪৬ সালে এস এম সুলতানের প্রথম আঁকা ছবির চিত্র প্রদর্শনী হয়। এর পর থেকেই চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন তিনি।
চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিতি
ছবি আঁকার জন্য ছুটে যেতেন কাশ্মীরে, কখনো পাঞ্জাবে, আবার কখনো করাচিতে। করাচি শহরে তিনি দুই বছর শিক্ষকতা করেন। ওই সময় চুঘতাই ও শাকের আলীদের মতো শিল্পীদের সঙ্গে এস এম সুলতানের পরিচয় ঘটে। ১৯৫০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চিত্রশিল্পীদের এক সম্মেলনে যোগ দেন। নিউইয়র্ক, বোস্টন, শিকাগো, ওয়াশিংটন এবং পরে লন্ডনেও তাঁর চিত্র প্রদর্শনী হয়।
শিশুদের প্রতি ভালোবাসা
শিকড়ের টানে ১৯৫৩ সালে আবারও নড়াইলে ফিরে আসেন গুণী এ শিল্পী। শিশুদের নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ছিল বড়। সব সময় চিন্তা করতেন শিশুদের জন্য কিছু একটা করার। চিত্রা নদীতে নৌকায় করে শিশুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। নড়াইলে নন্দনকানন নামে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল ও একটি আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। শিল্পী তাঁর শেষ বয়সে এসে শিশুদের জন্য শিশুস্বর্গ ও চারুপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও নড়াইলে কালের সাক্ষী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
এটি নড়াইলের রূপগঞ্জের এস এম সুলতানের সংগ্রহশালার পাশেই অবস্থিত। শিল্পীর স্বপ্নের তুলির আঁচড়ে তিলে তিলে গড়া শিশুস্বর্গে শিশুরা আলোকিত হচ্ছে, আলো ছড়াচ্ছে দেশ-বিদেশে। এস এম সুলতান শুধু বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন, তিনি একজন সুরসাধক এবং ভালো বংশীবাদকও।
অর্জন ও বিদায়
১৯৮২ সালে এস এম সুলতানকে যুক্তরাষ্ট্রের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘এশিয়ান ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে ঘোষণা করে। একই সালে তিনি একুশে পদক, ১৯৮৫ সালে চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা এবং ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন এ কিংবদন্তি।
১৯৮০ সালের শেষের দিকে শিল্পী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৯৪ সালে এস এম সুলতানের শেষ চিত্র প্রদর্শনী হয় ঢাকার গ্যালারি স্টোনে। ১৯৯৪ সালে ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী পটুয়া এস এম সুলতানের তুলির আঁচড় চিরতরে থেমে যায়। পাড়ি জমান না–ফেরার দেশে।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা